Skip to main content

স্থির রোদ। গাছের ছায়া লুটোপুটি খাচ্ছে মাটিতে। রোদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা। মাটি কোল পেতে বসে। 

     মাটি জানে খানিকবাদে রোদ থাকবে না, ছায়া থাকবে না। গাছটাও একদিন থাকবে না। সে থেকে যাবে। 

     গোঁসাই বসে গাছের তলায়। চাঁদের আলোয় ছায়ারা খেলছে। গোঁসাই এ ছায়া রোদের আলোতেও দেখেছে। চাঁদের আলোয় মায়া বেশি। সত্যে আর কল্পনায় মেশানো যে! রোদের আলো বড্ড স্পষ্ট। জ্ঞানের অহংকারের মত। জ্ঞানের চেয়ে জ্ঞানী বাজে বেশি। চাঁদের আলো অনুভবীর। সে অনুভবী জ্ঞানী রসের খবর জানে না শুধু, সে জ্ঞানী রসিকও। রসের সমঝদার!

     সামনে মাঠ। বাঁকা রাস্তা। রাস্তা গিয়েছে গ্রামের বুক চিরে। সমস্ত গ্রাম ঘুমিয়ে। রাত একটা হবে। এবার রথে পুরী যায়নি গোঁসাই। শরীর ভালো না। ক্লান্ত। 

     কে শান্তি কাড়ে গোঁসাই? 

     সামনে দাঁড়ানো বটগাছটা জিজ্ঞাসা করল। 

     গোঁসাই বলল, রিপু। রিপু সুখ দেয়, ভোগ দেয়, উল্লাস দেয়, রঙ দেয়, প্রতিশ্রুতি দেয়, ঘোর দেয়, রূঢ় বাস্তবকে অস্বীকার করার জন্য মুখ ফেরানোর দিকও দেয়… দেয় না কেবল শান্তি… তাই সে রিপু। 

     সব শান্ত। সব শান্ত হলে গোঁসাইয়ের মনের মধ্যে সুর বাজে। সে সুরে কথা নেই। বাধা নেই। গোবিন্দের বাঁশির মত। সুর নামছে আকাশ থেকে। সুর উঠছে মাটি থেকে। 

     গোঁসাই আকাশের দিকে তাকালো। রথ বেরিয়েছে যে! পূর্ণচন্দ্র, এই তো তিনি। তাঁর রশি টেনে নিয়ে চলেছে তারার দল। গোঁসাই হাত জড়ো করে কপালে ঠেকালো। বুকে হাত দিল। হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ শুনলো। এই তো রথে তিনি। গোটা সংসারই তো রথ। যিনিই রথ, তিনিই পথ, তিনিই রথের রশি, তিনিই রশি ধরা হাত। চলাটাও তিনি, থামাটাও তিনি। গোঁসাইয়ের প্রাণের তীরে লাগল জোয়ারের জলের ধাক্কা।

     গোঁসাই উঠে দাঁড়ালো। তার শরীর জুড়ে আনন্দের স্রোত। এখন শুধু গানের সময় না। এখন সময় নাচের। গোঁসাই পায়ের নূপুর বাঁধল। উঠানে এসে দাঁড়ালো। একতারার তারে লাগল টান। গোটা বিশ্বে ঝংকার বেজে উঠল। রথের চাকার ঘড়ঘড়ানি বাজলো বুকে। গোঁসাই নাচছে। গাইছে। সে গানে সুর আছে। কথা নেই। নাম আছে। প্রভুর নাম। নাম মানে কথা না। সব কথা যা দিয়ে শুরু সে-ই নাম। নামের চাকাই রথের চাকা। গোঁসাই রথ নিয়ে বেরিয়েছে। চারদিকে চলছে নামের লুট। কুড়িয়ে নিতে জানতে হয়। বুকের পাঁজরের কোঁচড়ে তাকে গোপন করতে শিখতে হয়। তবে চলা হয়ে ওঠে চলা।