Skip to main content
 
 

==

        সমাজে নিয়ম-নীতির অভাব ছিল না। ধর্ম আর ধর্মপ্রাণ মানুষেরও অভাব ছিল না। তবু মেয়েটা দুশ্চরিত্র হল। কেন কিভাবে দুশ্চরিত্র হল সে নিয়ে তো বহু শাস্ত্র, পুরাণ, সাহিত্য, কবিতা লেখা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো হবে। সে সব কথা থাক। মেয়েটা যে দুশ্চরিত্র তার পাড়া প্রতিবেশীরা জানত, বাড়ির লোক জানত, ভগবান জানত। পাপের ভয় সবাই পায়। পাপের কিনারায় পায়, পাপে ডুবে গেলে আর ভয় থাকে না। যেমন বর্ষাকালে কালো মেঘ দেখলে ভিজে যাওয়ার ভয় রাস্তায় বেরোতে। একবার ভিজে গেলে আর কালো মেঘে ভয় নেই।
        মেয়েটার জ্বর হলে পাপের কারণে হয়, মেয়েটার শরীর খারাপের দিন পিছোলে পাপের কারণে হয়, মেয়েটার বাড়ির কলে জল না এলে পাপের কারণে হয়, কালবৈশাখীতে শুকনো কাপড় উড়িয়ে ছিঁড়ে ফালাফালা করলে পাপের কারণে হয়। আসলে পাপের কারণে মেয়েটার এত কিছু হয় যে মেয়েটা আর মাথা ঘামায় না। পাড়ার লোকেরা তার পাপ বাঁচিয়ে যাতায়াত করে, ভগবান তার পাপ বাঁচিয়ে অঞ্জলি এড়িয়ে দূর্গাষ্টমীতে পাড়ার মোড় থেকেই পালায়। সাধু-মহাত্মা কয়েকজন তাকে কৃপা করবে বলে কাছে আসতে চেয়েছিল, সে ঘেঁষতে দেয়নি। কারণ সেই জানে। তবে তার মুখের ভাষায় কেন সাধু-মহাত্মার স্তবস্তুতির বদলে নোংরা কথা থাকে সে সমাজ বোঝে না। অথবা বুঝতে নেই।
        এইখানেই মুশকিল। মেয়েটা যখন বুঝল তার স্বামীর আর কয়েক মাস আয়ু, আর তার শ্বশুরের ইচ্ছাই হল তার স্বামীর মৃত্যুর পর তার শরীরটার ভাগীদার হওয়া, তখন সে কয়েক রাত মন্দিরে প্রার্থনা করে কাটিয়েছিল। মা কালীর মূর্তি। বাড়িরই মন্দির। সারারাত বসে কাটিয়েছিল। প্রথম প্রথম মনে হত মায়ের চোখদুটো কি উজ্জ্বল। মায়ের কানে তার সব আর্তি পৌঁছাচ্ছে। মা মুহূর্ত খুঁজছেন উত্তর দেওয়ার। কয়েক মাস গেল। মন্দিরে বসার না, বিয়ের। বিয়ে ঠিক নয়, যেন অপহরণ। মেয়েটার বাবা অধুনা চেন্নাইতে একটা মিষ্টির দোকানে কাজ করত। তাদের বাড়ি চন্দননগরে। বাড়িতে তাদের ঘর একটা, বাকি চারটে ঘরে চারটে ভাড়াটিয়া ছিল। ওতেই সংসার চলত। দুই দাদা নেশাখোর, বেকার। মেয়েটার বয়েস তখন চোদ্দো। এক ভাড়াটিয়াকে দাদু আর দিদা বলে ডাকত। পরে জেনেছিল ওই দিদাও ঐ দাদুর রক্ষিতা, বউ নয়। বউ থাকে বর্ধমানে। দাদু'র এখানে সোনার দোকান। দাদু একদিন তার মা'কে বলল, “রেবাকে আমার সাথে কয়েকদিনের জন্য দিন না, আমার স্ত্রী খুব অসুস্থ, বাড়িতে নাজেহাল হচ্ছি, ও ক'দিন গেলে আমার মেয়েদের একটু সুরাহা হয়।“
- কিন্তু ওর বাবা এখানে নেই...
- সে আমার উপর ছেড়ে দিন, বুঝতেই তো পারছেন, দুটো পরিবার নিয়ে আজকের দিনে চলা, একটা যে সারাক্ষণের লোক রাখব... বরং আমি না হয় এই ক'দিনের জন্য কিছু টাকা আপনাকে দেব...
        রেবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শুনছিল কথাগুলো। সে সদ্য স্কুল থেকে ফিরেছে। মা এখনও ভাত বাড়েনি। খিদে পাচ্ছে তার। সে মায়ের মুখের দিকে তাকালো, জানে মা, না বলবে। কারণ যেবারে তাদের পুকন স্যার সায়েন্স সিটি নিয়ে যাবে বলেছিল বাসে করে সব ছাত্রছাত্রীদেরকে, তার মা পাঠায়নি তো... আর এতো কয়েকদিনের জন্য...
        তার মা ‘হ্যাঁ’ বলল। রেবা জানে তার কানে সে যা শুনল তার সত্যির মত নয়, তবু সত্যিই শুনল সে। রেবা তার পোষা টিয়াটার দিকে তাকালো, মাছের অ্যাকোরিয়ামটার দিকে তাকালো... ভাত খেলো না... বেরিয়ে গেলো... দাদু বলল, তুমি চিন্তা কোরো না রেবা, আমার এই বউ তো থাকলই তোমার মাকে দেখার জন্য।
রেবারা বর্ধমান যখন পৌঁছালো রাত হয়েছে।
 
        বাড়ির সামনে লোকে লোকারণ্য। দাদুর আগের বউয়ের স্ট্রোক হয়েছে, একটা দিক পড়ে গেছে। বাড়িতে হুলুস্থুলু কাণ্ড। রেবা শোকের, মন খারাপের সময় পেলো না... কাজে লেগে গেল। সে অনেক কিছু পারে। রান্না তো বেশ কিছু পারে। সেলাই জানে। ভালো মত খাবার পরিবেশন করতে জানে। একটা বয়স্ক লোক জবুথবু হয়ে বুড়োটার বউয়ের কাছে বসে। কাঁদছে। কিন্তু কথা বলছে না। পরে জেনেছিল ওই বুড়োর বড় ছেলে। বোবা কালা। পরেরদিন সকালেই মন্দিরে গিয়ে ওর সাথে রেবার বিয়ে হয়ে গেল। বুড়োর বউ চায় মরার আগে ছেলের বউ দেখতে। ছেলের বয়েস চল্লিশ। রেবা আশ্চর্য হয়ে দেখল বিয়ের সময় তার মা, দাদারা এলো। বাবা ফোনে কথা বলল। তার নাকি অনেক ভাগ্য এমন বড় পরিবারের বউ হল সে। রেবা নিজের মধ্যে নিজেকে থামিয়ে ফেলেছিল। তার শাশুড়ি মারা গেল না। কিন্তু রেবা একরাতের অন্ধকারে ধর্ষিত হওয়া কাকে বলে বুঝে গেল। এতদিন এর ওর মুখে শুনেছে। আজ দেখল। নিজের থেকে নিজেকে আলাদা করে দেখল। বোবার গোঙানি শুনল। শ্বশুরের প্রশ্ন শুনল। শ্বশুর আঙুল দিয়ে পরেরদিন পরীক্ষা করে দেখল আগের রাতে সব ঠিক হয়েছিল কিনা। তারপর নিজের ছেলের গালে একটা থাপ্পড় মারল – বলল, "বারণ করেছিলাম না... ও শুধু লোক দেখানো তোমার বউ... তোমার আয়ু আর এক বছরও নয় ডাক্তারের মুখে শোনোনি?" তার শাশুড়ি বিছানায় চুপ করে শুয়ে তাদের এই নাটকীয় মুহূর্তের সাক্ষী ছিল... রেবা মেঝেতে বসে, তার খাটে ওঠার অধিকার নেই।
        রেবার স্বামী মারা গেল দেড় বছরের মাথায়। কিডনির রোগ ছিল। রেবা'র অবাক লেগেছিল, সিঁদুরের মোহতেই কিনা জানে না সে, তবু আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল সে স্বামীকে বাঁচানোর। লোকে তাকে বলত তখন সাবিত্রী। লোকে জানত না, তার স্বামীর চিকিৎসার খরচের বিনিময়ে তাকে তার শ্বশুরের বিছানায় রাত কাটাতে হয়। নাকি জানত হয়ত, অনেক কিছু জেনেও জানতে নেই যেমন এও তেমন কিছু একটা হবে। রেবা এখনো মাঝে মাঝে রাত্তিরে তাদের শ্বশুরবাড়ির কালী মন্দিরে বসে থাকে। দেখে পিঁপড়ে উঠছে মূর্তির গা বেয়ে। মাছি বসছে মূর্তির নাকে চোখে। গায়ের কয়েকটা জায়গায় রং চটেছে।
 

==
        আচ্ছা পাঠক, খুব অচেনা গল্প কি? সে বর্ধমান হোক কি বিশাখাপত্তনম, এ ঘটনা খুব অপরিচিত তো নয়। আসলে ধর্ম বলো, নিয়ম বলো, সব তো পুরুষের মেধাজাত। পুরুষেরা জানে, মেধার লিঙ্গ হয়। মেধার পুংলিঙ্গ সৃষ্টির, মেধার স্ত্রীলিঙ্গ অনাসৃষ্টি, ঈশ্বরের অপচয়। তাই নিয়ম বানানোর পর সে রাস্তায় হাঁটার দায় নারীর। সেই নারী যদি কৃতজ্ঞ হয় তবে প্রতি পদক্ষেপে সে পুরুষের ঋণ স্বীকার না করে পারে না। বিশেষ করে তার নারীত্বকে মাতৃত্বে এনে তার জীবনকে সার্থক করে তোলার জন্য।

        পাঠক দেখুন, আমার কথা ছিল কিন্তু আমি মেয়েটার গল্প বলব না, মানে সে কি করে দুশ্চরিত্র হল, তবু বলেই যাচ্ছি। থামতে পারছি না। আসলে মনের মধ্যে একটা অজাত গল্পের যন্ত্রণা দশমাসের গর্ভ যন্ত্রণার মতই হবে হয়তো। তো মেয়েটার স্বামী মারা গেল। তার দু'মাসের মধ্যে তার শাশুড়ি। তার শাশুড়ি বলেছিল, মানে জিভ জড়িয়ে জড়িয়ে বলেছিল, তার স্বামী একটা নরপশু। রেবা যেন পালিয়ে বাপের বাড়ী চলে যায়, নইলে ছিঁড়ে খাবে সে। রেবা বলে নি সংসারে পশুর থেকেও ভয়ংকর হল নপুংসক; এক পশুর তাও নিজের ভোগ্যের উপর অন্তত দখলদারি বোধ থাকে, সে হিসাবেও তাকে কিছুটা যত্নে রাখার চেষ্টা করে, আর নপুংসক? সে তো অন্যের এঁটোকাটা খেয়ে নিজের ইন্দ্রিয়পোষণ করে। তার দাদারা মাল খেয়ে এসে রাতে শোয়ার সময় তার ভুল জায়গায় হাত দেয়নি? মা জানত তো... বলেছিল নেশার ঘোরে ছেলেদের অমন বিকার ওঠে... তাই মেয়েদের উচিৎ নিজেকে সামলে চলা।
        রেবা সামলে চলার কথা এখন ভাবে না। কারণ সে পোয়াতি। শ্বশুরের না তার স্বামীর সে জানে না। জানার দরকারই বা কি? কিন্তু মুশকিল হল অনুপকে নিয়ে। পাঠক, একটু অনুপের গল্প বলে নিই। তারপর আবার রেবাতে ফিরছি। ও তার আগে একটা কথা। আপনারা হয়ত ভাববেন, আমি রেবার চেহারার বর্ণনা করলাম না তো। ইচ্ছা করেই করিনি। একটা মেয়ে। সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে। কানা, খোঁড়া নয়। ব্যস এতটাই জানুন পাঠক। রূপের তারতম্যে যেটুকু ফারাক হয়, মেয়েদের জননাঙ্গের উপস্থিতি সেটুকু ফারাক বুজিয়ে দিতে পারে লোলুপ পুরুষের চোখে। এটাই বিধির বিড়ম্বনা।
        অনুপের কথা বলছিলাম। অনুপের বয়েস আমাদের গল্পের কালে ত্রিশ। বউ পলাতক। ছেলে নিয়ে যায়নি। ছেলে অভ্র থাকে বাপের কাছে। ঠাকুমার প্রাণ সে। অনুপের ভালো লাগে রেবাকে। রেবারও ভালো লাগে। তার প্রধান কারণ হয়ত একমাত্র অনুপই তার সাথে কথা বলত। সে গ্যাস সারাতে আসত তাদের বাড়ি। এমনকি বাড়ি ফাঁকা থাকলেও কোনোদিন রেবার বুকে পাছায় হাত দেওয়ার চেষ্টাও করেনি। অনুপের ওসব ভালো লাগত না। তাতেই নাকি ওর বউ পালিয়েছে। তার চাহিদা নাকি প্রচুর, অনুপ বলেছে। রেবা শুনেছে। মনে মনে কল্পনা করার চেষ্টা করেছে একটা পুরুষ আর নারী একটা ঘরে শুয়ে আছে। ঘর অন্ধকার। খিল দেওয়া। অথচ কেউ জোরাজুরি করছে না। নিজেকে গেঁথে দিয়ে শরীরের সাথে ভালোবাসা জানাতে চাইছে না। এরকম হয় নাকি?
        দিন গড়ালো। রেবার একটা ছেলে হল। রেবা নাম রাখল ভীম। তার মহাভারতের সব চাইতে পছন্দের চরিত্র। তার আদর্শ পুরুষ। লোকে হাসল। অমন ক্যাংটা ছেলের নাম ভীম? পাঠক মনে আছে, বলেছিলাম রেবা ভালো সেলাই জানত। সেই সেলাইকেই সে বেঁচে থাকার অস্ত্র বানালো। তাকে সাহায্য করল অনুপ। নানা দোকানের অর্ডার এনে দিল। দেখতে দেখতে তার বেশ নাম হল। দূর থেকেও তার কাছে সেলাইয়ের অর্ডার আসতে শুরু করল। কলকাতা যাতায়াত শুরু করল। অর্ডারের পরিমাণ বাড়ল। লোকে তার আর অনুপের সম্পর্কের কথাও জানল।
 
        একদিন মাঝরাতে শ্বশুর তাকে আর তার ছেলেকে পোড়াতে এলো। রেবা কিচ্ছু বলল না। সে ভীমকে কোলে নিয়ে চুপ করে খাটে বসে থাকল। ঘুমন্ত ভীমের মাথাটা তার বুকে গোঁজা। রেবা তার শ্বাস শুনছে, নিজের বুকের ভিতরের ধড়ফড়ানি অনুভব করছে। তবু চুপ করে তার শ্বশুরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। দুই টিন কেরোসিন তেল তার বিছানায় ঢালল, তার গায়ে দিল, ঘুমন্ত ভীমের গায়েও দিল। এক লহমার জন্য রেবার কান্না পেয়েছিল। মায়ের মুখটা মনে পড়ল, মন্দিরের রংচটা দেবীর মুখ মনে পড়ল। আশ্চর্য হল এই আসন্ন মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও তার কারোর উপর কোনো ক্ষোভ বা রাগ হল না। সে চোখ বন্ধ করল। অপেক্ষা করল আগুনের তাপের। শরীরের জ্বলনের। কিন্তু কিচ্ছু হল না। একটা গোঙানির আওয়াজ শুনে চোখ মেলে তাকালো। তার পায়ের কাছে শ্বশুর পড়ে গোঙাচ্ছে, কাঁদছে... বলছে, আমায় ছেড়ে যেও না... সব বিষয় সম্পত্তি তোমার হবে... কেউ পাবে না... কেউ না... কেউ না...
        রেবা ভীমকে কোলের থেকে নামালো। তার শ্বশুরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আপনি শুতে যান, আমি কোত্থাও যাচ্ছি না।
 
        শ্বশুর শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ রেবার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করল। তারপর বাইরে চলে গেল। রেবা শাড়ি ছেড়ে, ভীমকে খালি গা করে মেঝেতে মাদুর পেতে শোয়ালো। জালনার ধারে এসে নিজে দাঁড়ালো। সারা পৃথিবী জুড়ে কামুক, অসহায় পুরুষে পুরুষে ভরতি। একা নারী যেন সে। কি একটা আত্মবিশ্বাসে তার বুকটা ভরে উঠল। সে ভীমের দিকে একবার তাকালো। তারপর সারারাত জানলায় দাঁড়িয়েই কাটালো। আকাশে একটা উলঙ্গ চাঁদ তাকে দেখতে দেখতে ভোরের আলোয় ডুবে গেল। তার অপেক্ষা অনুপের জন্য। আর একটা মা ছাড়া প্রাণের জন্য –অভ্র।
 
***** ***** ***** ***** *****
 
        ওরা পালিয়েই বিয়ে করল। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে। ভীমকে আগে থেকেই অনুপের বাড়ি পৌঁছিয়ে দিল বৈশাখী, তার সাথে সেলাইয়ের কাজ করে। প্রথম প্রথম তার শ্বশুরের কিছু হুমকি আসত। ক্রমে তাও থেমে গেল। তার শ্বশুর বর্ধমান রেল স্টেশানে কাটা পড়ল। লোকে বলল আত্মহত্যা। রেবার মনে হয় না। রেবা সংসারে মন দিল। অভ্র ক্রমে তার ন্যাওটা হয়ে উঠল। বছর ঘুরতে তার একটা মেয়ে হল, সে নাম রাখল পারিজাত। ডাক নাম পরী। অনুপ গ্যাসের কাজ ছেড়ে দিল। রেবার ব্যবসা তখন রমরমা। উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত তার কাস্টমার। পূজোর চারমাস আগে থেকে দূর্গার সাজের অর্ডারের ধুম পড়ে গেল। সাথে সাথে শাড়ির অর্ডার তো আছেই। রেবা আর অনুপ লোক রাখল। রেবা শিলিগুড়িতে আরেকটা দোকান দিল। নিজে মাসের দশ বারোদিন ওদিক সামলে আসত। বাকিটা সামলাতো অনুপ। ছেলেমেয়েগুলোর দায়িত্ব নিলেন শাশুড়ি। অনুপের মা বহুদিন হল বিধবা। বিয়ে হয়ে এসে থেকে সংসারে এত স্বচ্ছ্বলতা দেখেননি। প্রথম বারের পূজোয় যেদিন একটা দামী শাড়ি রেবা তার হাতে তুলে দিল, কি কান্না তার শাশুড়ির। তার নিজের চোখেও জল এসেছিল। তার নিজের মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছা করেছিল। যায়নি। কোনো যোগাযোগ রাখতে তার রুচি হয় না। তবু কষ্ট তো হয়।
 

==
        রেবা একটা জিনিস খেয়াল করল। ইদানীং অনুপের চালচলন যেন একটু বদলে যাচ্ছে। শিলিগুড়ি থেকে আসতে চাইছে না। ফোনে ডেকে ডেকে আনাতে হচ্ছে। কথায় ঝাঁঝ বাড়ছে। রেবা প্রথম প্রথম ভাবত যে সুখী মানুষ, হয়ত এত কাজের চাপে মাথা ঠিক রাখতে পারছে না। কিন্তু তার সন্দেহটা বাড়ল যখন শিলিগুড়ির হিসাব নিয়ে বসল। প্রতিমাসে ছয় কি পাঁচ হাজার টাকার ঘাটতি। রেবা অনুপকে কিছু বলল না। বৈশাখীকে নিয়ে বাপের বাড়ি যাওয়ার নাম করে শিলিগুড়ি এসে উঠল। দু'দিনেই সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল। অনুপ আবার বিয়ে করেছে এখানে। তাদেরই কারখানায় কাজ করে একটা বউকে, বউটার একটা বাচ্চাও আছে। শিলিগুড়িতে অনেকেই জানে ঘটনাটা। বিশেষ করে তারা যে দোকানে মাল দেয়। রেবার কষ্ট হল কিনা সে নিজেও জানে না, কিন্তু মাথা থেকে পা অবধি একটা ঘেন্না আর রাগ বয়ে গেল। সে আশিষদাকে ফোন করল। এখানকার বাজার কমিটির সভাপতি। রেবাকে বোন বলে ডাকে। তারপর কুড়ি-পঁচিশটা ছেলে নিয়ে গিয়ে মাঝরাতে চড়াও হল অনুপের নতুন ভাড়াবাড়িতে। বউটা আর বাচ্চাটাকে কিচ্ছু বলতে আগেই বারণ করে দিয়েছিল রেবা। ছেলেগুলো অনুপকে রাস্তায় বার করে বেধড়ক মার মারল যতক্ষণ না জ্ঞান হারায়। আশিষদা পুলিশের দিকটা সামলালো। জ্ঞান ফিরতে কিছুটা প্রাথমিক চিকিৎসা করানোর পরে ট্রেন ধরে সোজা বর্ধমান। আসার আগে আশিষদাকে বলল, কারখানারটার একটা ব্যবস্থা করো, আমি ওটাকে বেচব।
        অনুপের যে একটা বিষদাঁত ছিল তা আগে কেন টের পায়নি রেবার এটাই বেশি আশ্চর্য লাগত। অনুপ সুস্থ হল। তবে একেবারে কেঁচোর মত হয়ে থাকল রেবার কাছে। রেবা জানত এটাও আসলে ছদ্মবেশ। বেঁচে থাকার ছদ্মবেশ। লোকে কেন যে মেয়েদের মায়াবিনী বলে, ছেলেদের মত ছলচাতুরী কি তারাও পারে? আসলে ছেলেদের বুদ্ধি'র একটা অংশ বড় কাঁচা, রেবা টের পায়। সেটা যত উঁচুতেই উঠুক না কেন, কোথাও একটা ছন্নছাড়া। তারা বাঁধতে জানে না। অথচ বাঁধা ঘরের মধ্যে হাঁপিয়ে উঠতে জানে। সে হাঁপিয়ে ওঠাটাই কতটা আসল কে বলবে? কারণ চার দেওয়ালের মধ্যে আড়ালও সে-ই খোঁজে বেশি। রেবা একটা করুণা আর ভালোবাসার মধ্যস্থতায় মেনে নিল অনুপকে। তাছাড়া তার আর উপায়ও ছিল না, নাকি তার শাশুড়ির করুণ মুখ – “তুমি ছেড়ে চলে যেও না বউমা”... কান্না... অভ্র'র তাকে জড়িয়ে বাঁচা... সব মিলিয়ে সে নিজেও তো নিজের কাছে কম অসহায় নয়।
        বছর ঘুরতে লাগল। ভীম হতে লাগল ক্রমে অনুপের মত আর অভ্র হতে লাগল রেবার মত। ভীমটা অলস, বোকা, লোভী। আর অভ্রটা হল কর্মঠ, চালাক। ক্লাস এইট অবধি পড়ে অভ্র পড়ায় ইস্তাফা দিল। কাজে যোগ দিল। রেবা অনেক বোঝালো। কিন্তু কোথাও অনুপের একটা প্রশ্রয় ছিল। অভ্র কাজ শিখল দ্রুত। ভীম গড়িয়ে গড়িয়ে পড়াশোনা চালাতে লাগল। ব্যবসা যত বড় হতে লাগল অভ্র যেন তার চাইতে দ্রুত বড় হতে লাগল। এখন এমন হয় যে অভ্রের কাছে মাঝে মাঝে পরামর্শ করে রেবা ব্যবসার বিষয়ে। তবে যতই তার বিচক্ষণতা থাক, বড় হোক, শোয়ার সময় সে রেবার কোল ঘেঁষে ছাড়া শোবে না। রেবা কপট রাগ দেখালে অভ্র বলে, যাই তবে আসল মায়ের কাছে? রেবার বুকটা কেঁপে ওঠে। সে অতবড় ছেলেকে বুকে আগলিয়ে ধরে, যেন কারোর চোখে না পড়ে।
 

==
        রেবা কলকাতা থেকে ফিরে দেখে বাড়িতে একজন মহিলা বসে। সারা গা বেশ দামী দামী গয়না। শাশুড়ি একগাল হেসে বলল, পারমিতা গো, আমার অনুপের প্রথম ইস্তিরি। শাশুড়ির হাসিটা দেখে গা জ্বলে গেল রেবার। সে কিছুটা রুঢ় হয়েই বলল, তা হঠাৎ এবাড়িতে কি মনে করে?
- কি মনে করে মানে? আমাদের ডিভোর্স হয়েছে নাকি? আপনি জানেন না? আইনি মতে আমি এখনও অনুপের স্ত্রী। আর এই বিষয় সম্পত্তি সবের উপর আমারই অধিকার, আপনি তো উড়ে এসে জুড়ে বসা... এমনকি আমার বাবুটাকেও...

        তাই তো অভ্র কই? রেবার মাথায় বাজ পড়ল। সে তাড়াতাড়ি বলল, মা অভ্র কোথায়?
        পারমিতা জবাব দিল, আমার বাপের বাড়ি। তোমার মত মহিলার হাতে আমি আমার ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারব না... আমি অতটাও বোকা নই... অনুপ একটা ভেড়া তাই তোমাতে মজেছে... আর তোমার কথা আর কি বলব... নিজের শ্বশুরের সাথে যে...
        রেবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অভ্রের ফোন সুইচ অফ্। অনুপ এখনও বড়বাজারে, ও আলিপুরে মাল দিয়ে আসবে। হঠাৎ দেখল দরজার কাছে একটা লোক দাঁড়িয়ে... কে? আরে! তার ছোড়দা তো...
        রেবার মাথা কাজ করছে না, ও এখানে কেন? ছুটে গেল, দাদা তুই?
রেবা এক মুহূর্তে পারমিতার কথা ভুলে গেল, দাদার উপর রাগ অভিমানের কথা ভুলে গেল...

        বিকাশ বলল, মায়ের ক্যান্সার, এক্কেবারে শেষ অবস্থায়, তোকে একটু দেখতে চাইছে রে... যাবি?
        রেবার মাথাটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল। সময়ে অসময়ে সে মায়ের কথা অনেকবার ভেবেছে। কখনও আশ্বাস পেয়েছে, কখনও রাগ, অভিমান হয়েছে, কিন্তু মানুষটাকে যে এতটা ভালোবাসে সে এই মুহূর্তে যতটা সত্যি বলে অনুভব করছে, সারাজীবন যেন করেনি।
        রেবা পারিজাত আর ভীমকে নিয়ে বেরিয়ে গেল দাদার সাথে। পরেরদিন অনুপও এলো চন্দননগরের বাড়িতে। কিন্তু এ কি অবস্থা তার পরিবারের? এ তো ভিখারির মত অবস্থা। বাবাকে দেখে চিনতেও পারে নি সে প্রথমে, কোনো ভাড়াটিয়া ভেবেছিল। তার সমস্ত অভিমান গভীর অপরাধবোধ হয়ে তাকে কুরে কুরে খেতে লাগল। সে তার পরিচিত যত মানুষ ছিল ফোন করে ডাক্তারের খোঁজ নিল। মাকে নিয়ে এখানে সেখানে ছুটল। সব জায়গায় একই উত্তর, বড় দেরি করে ফেলেছেন, আর বড়জোর তিনমাস। সে ঠিক করল মুম্বাই যাবে। অনুপ টিকিট কাটল।
        যাওয়ার আগের দিন রাতে তার মা তাকে কাছে ডাকল, রেবু শোন...
        রেবা কাছে গিয়ে বসল, মুখের কাছে কান আনল।
- আমার আর বেশিদিন নেই রে মা, তোর উপর আমরা যা করেছি ভগবান তার বিচার করবেন, তুই আমায় একটা কথা দে মা, বাবাটাকে একটু দেখিস... সে তোর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা পর্যন্ত বলতে পারে না... আমার বুকটা ফেটে যায় মা... এতটা শাস্তি তুই ওকে দিস না... আমি মরেও শান্তি পাব না রে...

        রেবার গাল গড়িয়ে চোখের জল তার মায়ের বালিশে পড়ছে টপটপ করে, এত কান্না ছিল তার বুকে... তার রঙচটা দেবীর কাছে প্রার্থনা করতে ইচ্ছা করল... করল না... তার মা আরো কিছু বলছেন...
- তোর বাবা অনেকদিন মাংস খায়নি রে, তুই একটু কাল পাঁঠার মাংস আনাবি? আমায় বা দাদাদের দিতে হবে না... শুধু তোর বাবার মত... অনেক খরচ হবে রে... তুই আমার পিছনে আর খরচ করিস না... বরং বাবাকে...

        রেবা বাইরে চলে এলো। তার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে মনে হচ্ছে... অনুপ কোথায়... সে কোথাও যাবে না...।
        রেবার মা এক মাসের মাথায় মারা গেলেন। তার দুই দাদা সোনার দোকানে মুম্বাইতে কাজ করে। তারা ফিরে গেল। রেবাকেও ফিরতে হবে। বাবার হাতে এক হাজার টাকা দিয়ে বলল, তুমি চিন্তা কোরো না, আমি প্রতিমাসে এসে তোমার খোঁজ নেব। তার বাবা কাঁপাকাঁপা হাতে তার মাথায় হাত দিতে গিয়েও সরিয়ে নিলেন, চোখ ভরতি জল নিয়ে জানলার দিকে ফিরে শ্বাস টেনে বললেন, ক্ষমা করিস মা..
 

==
        এই একমাসে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে সে এসেই বুঝল তার শাশুড়ির ব্যবহারে। যেন চিনতেই পারছেন না। আরো স্পষ্ট হল পারমিতা আর অভ্র যখন বিকালে এলো। অভ্র তার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। পারমিতা এসেই বলল, তুমি এসে গেছ, আমার কিছু কথা আছে তোমাদের সাথে, ঘরে চলো...
        বসার ঘরে সবাই বসল। ভীম আর পারিজাত রেবার দুই দিকে। পারমিতা আর অভ্র সোফায়। অনুপ দাঁড়িয়ে থাকল। তার শাশুড়ি একটা মোড়ায়। পারমিতা সোজাসুজি অনুপের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখো, তোমায় যখন আমি ছেড়ে গিয়েছিলাম তুমি একটা রাস্তার ভিখারি ছিলে। তাই তোমার কাছে খোরপোশ চাইতে আমার আত্মসম্মানে লেগেছিল। আজ তোমার হাতে দুটো রাস্তা। এক, তুমি ওকে নিয়ে ভিন্ন হও এই জমি-জায়গা কারখানা বাবুর নামে লিখে দিয়ে, অথবা তুমি ওকে ছেড়ে দাও, আমার সাথে আবার সংসার পাতো।
        ঘরে একটা নিঃশব্দতা নেমে এলো। রেবা অনুপের দিকে তাকালো। অনুপের দৃষ্টি স্থির মাটির দিকে। রেবা কি কিছু ভাবছে? রেবা নিজেও বুঝতে পারছে না। মাথার উপর পাখা ঘোরার আওয়াজটা শুনছে। সামনের জানলা দিয়ে রেললাইনের ধারের বিলটা দেখা যাচ্ছে, সেদিকে তাকিয়ে দেখল কয়েকটা হাঁস জলে নামার চেষ্টা করছে। পরিতোষদের হাঁস ওগুলো। দৃষ্টিটা ঘরের ভিতরে এনে একবার ভীম আর পারিজাতের মুখের উপর রাখল, মুখ দুটো ভয়ে, বিস্ময়ে থমথম করছে। ইচ্ছা করেই অভ্রের দিকে তাকালো না রেবা। অনুপের দিকে তাকাতেই দেখল সে তারই দিকে তাকিয়ে। অনুপ তাকে কিছু একটা বলতে চাইছে। রেবা ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকালো। বুকটা তবু ধড়াস ধড়াস করছে। অনুপ বলল, "আমরা আবার শূন্য থেকে শুরু করতে পারব না, কি বলো? তুমি পারবে না? তুমি যদি আমার সাথে থাকো আমি সব পারি রেবা...”
        অনুপের গলা বুজে এলো। রেবার মনে হল এত সুখ তো সে সারাজীবনেও পায়নি। এত সুখ... এত... এত এত... তার গাল বেয়ে জলের ধারা নামল... তার রঙচটা দেবীর মুখটা মনে পড়ল... সে কোনোরকমে কান্না থামিয়ে বলল, পারব।
 
 
        পাঠক। এই গেল রেবার ইতিহাস। সমাজের চোখে নার্সিংহোমে কাজ করা আয়া, দুশ্চরিত্র। কেন জানো? সে সোজা মেরুদণ্ডে হাঁটে, আয়া হলে যতটা নম্র হওয়া উচিৎ ততটা তো নয়! তাছাড়া বাকি পুরুষ কর্মচারীরা যে যে সুযোগ পায় আয়াদের থেকে সেগুলোই বা সে দেবে না কেন? নারীর শরীর কি তার একার? তা এমন দুশ্চরিত্রা মেয়েমানুষ কয়েকটা সেলাই মেশিন কিনবে বলে নাকি পয়সা জমাচ্ছে... ভাবো একবার কি স্পর্ধা... আয়ার আবার স্বপ্ন দেখা...
        রেবা এসব ভাবে না। আসলে রেবা এখন আর কিছুই ভাবে না। সে জানে মানুষে অভাবে তবু বাঁচে, অসম্মানে না। অনুপ তাকে সম্মান করে। আজকাল সেও করে। তার ভালো লাগে। বাঁচতেই কেমন ভালো লাগে। আকাশের ন্যাংটো চাঁদের সাথে কথা বলে। মায়ের সাথে কথা বলে। রঙচটা দেবীর সাথে কথা বলে। সে দেবীকে কথা দিয়েছে তার দিন ফিরে গেলে সে দেবীকে রঙ করিয়ে দেবে। দেবেই দেবে।
 
(ছবিঃ সুমন)