Skip to main content
 
 
      নিজে নিজেই কথা বলছে বেলা। শাড়িটা ফিরিয়ে দিয়ে আসা যেত হয়ত। বোনের শাড়ি। কিন্তু থাক, কথাগুলো শোনাতে এই শাড়িটাই কাজে দেবে। টোটোতে আসতে আসতেই ভেবে রেখেছিল কথাটা। 
      মঙ্গল ঘরে ঢুকতেই শাড়িটা খাটের উপর ছুঁড়ে ফেলে বলল, "তোমার লজ্জা করে না, বিয়ে হয়ে গেছে এতগুলো বছর হয়ে গেল, মনে হয় না একটা শাড়ি কি সায়া কি ব্লাউজ নিজের হাতে করে কিনে এনে দিই।" 
      মঙ্গল নীল রঙের একটা ঢোলা প্যান্ট পরে আছে, কোমরটা টাইট, কত বছর আগে কেনা মনে নেই, খাটের এক কোণায় বসে আছে। খাটের উপর লাল রঙের হাতকাটা জামাটা পড়ে। জামাটা বেলার টাকাতেই কেনা। বেলা আয়ার কাজ করে, মঙ্গলের মুদির দোকান। দোকানে সে একাই বেশিরভাগ সময় থাকে, খদ্দের আর জিনিস দুই-ই বাড়ন্ত।
      মঙ্গল আড়চোখে দেখল বেলা একটা নীল সায়া আর আকাশী ব্লাউজ পরে তার সামনে দাঁড়িয়ে। এর কোনোটাই সে কিনে দেয়নি। এরপর কি কি বলবে বেলা মঙ্গল জানে। পাশের ঘরে উনিশ বছরের ছেলে। জেগে আছে, কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি না হলে ঢুকবে না। মানে বেলা না কাঁদলে ও আসবে না। মঙ্গল দেখল বেলার চোখ শুকনো, মুখের ভাবটা রাগের। সমস্যা একটাই, রাত বারোটা প্রায়, তাদের এদিকটা ফাঁকা ফাঁকা। কাল সকাল হলেই কার্তিক দোকানে এসে গুলতানি মারবে..., কি হয়েছিল দাদা...? বউদি কেন চেঁচাচ্ছিল...
      মঙ্গল একবার ঘাড় উঁচিয়ে কার্তিকদের বাড়ির জানলাটা দেখার চেষ্টা করল। বেলা ঝাঁঝিয়ে বলল, "থাক্...! আর পাড়া-প্রতিবেশির কাছে মানসম্মানের কথা ভাবতে হবে না। সবাই জানুক।"
      মঙ্গল ভাবল, জানার আর কি আছে, জানে তো সবাই। কিন্তু টাকা কি সে বাজে খরচ করে? কোনো নেশাই নেই। এমনকি বিড়িটা পর্যন্ত না। টাকা জমায়, তার শখ একটা পাকা বাড়ির। কেন হবে না? গরীবের জন্য তো কত স্কিম আছে। সে নিজে কিছু টাকা দিলেই হয় তার সাথে। মঙ্গল ছাদের দিকে তাকালো। পাখাটায় ঝুল। বেলাই ঝাড়ে। ঝাড়েনি অনেকদিন মনে হয়। টিনের দেওয়াল। এইভাবেই থাকবে সারা জীবন? না। তা কেন হবে? জমি তো তার নিজের।
      বেলা কাঁদছে। এইবার কিছু একটা ছুঁড়বে। ছুঁড়লেই ওঘর থেকে ছেলেটা আসবে যদি না কানে হেডফোন থাকে। কিন্তু বেলা কয়েকটা জিনিস ছুঁড়ে মারার পর ছেলেটা না এলেই ওদিকের দেওয়ালে ছুঁড়ে মারবে, বা বন্ধ দরজাটায়।
      মারতে হল না। ছেলে ঢুকল। গেল মাসে একটা মোবাইল কিনতে দশ হাজার টাকা চেয়েছিল। দেয়নি মঙ্গল। বেলা দিয়েছিল ছয় আর ওর মামা দিয়েছিল চার না পাঁচ কিছু একটা। ছেলেটা আজ কি প্রতিশোধ নেবে? অন্যদিন হলে মাকে সামলে নিয়ে তার ঘরে চলে যায়। আজ? 
      তুমি ছাড়ো না... আমি তোমায় শাড়ি কিনে দেব, বাবা তো ওরকমই জানোই তো... আমার মোবাইল...
      ব্যস... জানত মঙ্গল... সে ছেলেটার চোখের দিকে তাকালো। ছেলেটা চোখ ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল..., "কি করে যে এমন একটা কিপটে মানুষের সাথে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলে..."
      মঙ্গলের মনে হচ্ছে দেয় শালাটার মাথাটা ফাটিয়ে... হাড় বজ্জাত ছেলে... পাজির পা-ঝাড়া...
      বেলা বলছে, “তুই জানিস না বাবু... তোর যখন বউ হবে তুই বুঝবি, সব মেয়েই চায় তার স্বামী নিজের হাতে করে কিছু একটা কিনে আনুক... এই যে তোর বাবা রাস্তা দিয়ে যায়... এত মেয়েমানুষ এত সুন্দর সুন্দর শাড়ি পরে যায়... ওর ইচ্ছা হয় না তার নিজের ঘরের মেয়েছেলেটার জন্য একটা কিছু নিয়ে যাই...
      মঙ্গলের বেশ মজা লাগছে। সে পরিমলের দিকে তাকিয়ে। পরিমলের লজ্জায় কানদুটো লাল। ছেলেটা মায়ের রঙ পেয়েছে। ভাগ্যে ভীষণ ফর্সা। পরিমল এই সব কথা শুনে খুব লজ্জা পায়। লজ্জা পায় না, সেয়ানা মাল... নিজের বউয়ের কথা শুনেই অমনি...
      বেলাকে নিয়ে ওঘরে চলে গেল পরিমল। কার্তিকদের বাড়ির আলো নেভানো।
পরিমল গা ধুয়ে এসে শুলো। বিছানাটা তেঁতে আছে এত গরম। শালীর শাড়িটা আলনায় রেখে এসেছে। একবার দেখল মঙ্গল। কম করে দশ হাজার টাকা তো হবেই। "সে হোক বাবা, তার বর যাই করুক রেলে কাজ করে... আমি মরলে এই দুটোর..."
 
      চাঁদ উঠেছে। মঙ্গল উসখুস করছে। এত দেরি তো করে না! তবে কি ঘুমায়নি পরিমল এখনও? মঙ্গল উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে বাইরে এলো, একটা সিগারেট খাবে আজ, ভায়রা ভাই দিয়েছে। দামী সিগারেট। সামনে এক ফালি উঠোন। তারপর মাঠ। দূরে হাইরোড। লরি যাওয়ার আওয়াজ আসছে। মঙ্গল সুখটান দিয়ে বসতে যাবে, হঠাৎ কার যেন কথা বলার আওয়াজ শুনলো। তাড়াতাড়ি উঠে বাড়ির পিছন দিকে এসে দেখে বেলা আর পরিমল পেয়ারা গাছটার নীচে মাদুর পেতে শুয়ে গল্প করছে। তাকে দেখেই পরিমল বলল, "বাবা এদিকে এসো... মা বলছিল, এ বছর পুজোতে পুরী যাবে? গণেশরা নিয়ে যাচ্ছে, মাথা পিছু সাড়ে চার হাজার টাকা। আমায় বলেছে আমাদের বারো দিলেই হবে।"
      মঙ্গল এসে বসল একটা ধারে, মাদুরের বাইরেই। একটুও হাওয়া নেই... বেলার দিকে তাকিয়ে বলল, "শুতে যাবে না..."
      বেলা বলল, "চলো..."
      এই অন্ধকারের মধ্যে কেউ কারোর মুখ স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছিল না। মঙ্গল চলে যেতে যেতে বলল, "যাও বাবু শুয়ে পড়ো... যদ্দিন না বিয়ে হয়..."
      পরিমল বলতে যাচ্ছিল, "পুরী..." কিন্তু শব্দটা গিলে ফেলে চুপ করে বসে থাকল। তার যখন বিয়ে হবে?... দূরে লরির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে... দশ মিনিট হাঁটলেই হাইরোড... সেটা ক্রশ করলেই ছুতোরপাড়া... মিতাদের বাড়ি... এখন ঘুমাচ্ছে... ওদের পাকা বাড়ি... এসি আছে...
      তাদের বাড়ির দিকে তাকালো। টিনের দেওয়াল চাঁদের আলোয় চকচক করছে... শালা মোবাইল দিল না...
 
 
      ঠক ঠক... "বাবা...?"
      "কি হল রে?"
      "তোমাদের ঘরে শোবো... ভয় করছে..."
      মঙ্গল উঠে দরজার কাছে যেতে যেতে বলল, "হারামজাদা..." বেলার হাসি শুনল... খিক্ খিক্...