Skip to main content

যীশুবাবার মন্দিরের সামনে প্রচণ্ড ভিড়। আজ শুক্রবার যে। আজ জলপোড়া দেওয়া হবে। মাটিপোড়া দেওয়া হবে কপালে তিলকের মত করে। তিনবেলা বাড়িতে মোমবাতি জ্বালিয়ে যীশুবাবার সামনে প্রার্থনায় বসতে হবে খালি। বলতে হবে, “হে পিতা, পুত্র আর পবিত্র আত্মা, আমার রোগ ভালো করে দাও”। এই বলে ডান হাতটা দিয়ে বাঁ কাঁধ, ডান কাঁধ আর তারপর বুকের মাঝখান ছুঁয়ে বলতে হবে, আমেন, আমেন, আমেন। ব্যস, আর কিছু না। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা, যীশুবাবার পুজো করলে কিন্তু অন্য ঠাকুরদেবতা পুজো করা যাবে না। এটা মেনে চলতে হবে।

তা রোগ ভালো করতে গেলে এ সব তো মেনেই চলতে হয়। এমনিতেও মল্লিকার পেটের ব্যথাটা সারছে না। রোজ বমি, সারাটাদিন চোঁয়া ঢেকুর, খাবারে অরুচি। ইস! ঘেন্না ধরে গেল জীবনে।

মল্লিকা একটা ঢিবির উপর বসে আছে। একটু আগে বমি হল। সকালের চা, বিস্কুট সব বেরিয়ে গেল। রাস্তা কম নাকি? সেই ক্যানিং থেকে অটোতে এসে, লঞ্চ পেরিয়ে গোসাবা এসে, এই ভ্যানে চড়ে আসা। মল্লিকার ক্লান্ত লাগছে। ডাক্তার বলছে পেটে পাথর হয়েছে। গলোস্টোন না কি, ওই। কিন্তু কাটাতে মেলা টাকা। সরকারি হাস্পাতালে ডাক্তার বলেছে দেরি হবে। অনেক লাইন। তাই এইখানে এসেছে মল্লিকা। বাড়ির সিংহাসনের সব ঠাকুর তুলে দিয়েই এসেছে। এতদিনের অভ্যাস, যদি আনমনে ভুলেটুলে গিয়ে পুজোটুজো দিয়ে ফেলে!

হাওয়া দিচ্ছে বেশ। কি বড় মন্দির এদের। চার্চ বলে। মল্লিকার ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসছে। সেই ভোরে বেরোনো। মল্লিকা একাই থাকে। বর মরেছে সাপে কেটে। ছেলেমেয়ে নেই। বয়েস এই চল্লিশ হব হব।

এক বুড়ি এসে বসল পাশে। বলল, কি ভিড় গো! একটু ফাঁকা হোক। হাঁটুতে ব্যথা। দাঁড়াতে পারি না। তুমি গেসলে?

মল্লিকা মাথা নাড়ল।

বুড়ি তার মুখের দিকে ভুরুটা কুঁচকে তাকিয়ে বলল, শরীর তো ভালোই খারাপ তোমার। একা এসেছ?

মল্লিকার এই কথাটা শুনতে লজ্জা করে। একা থাকতে হয় তাকে। কিন্তু চায় তো না। আগের মল্লিকার কত স্বপ্ন ছিল, ছেলেমেয়ে হবে, তাদের লেখাপড়া শিখিয়ে বড় মানুষ করবে। এখন সে সব নেই। এখন মল্লিকা যে ধান কেটে নেওয়া ক্ষেতের মত। রুক্ষ।

মল্লিকা বলল, হ্যাঁ।

বুড়ি বলল, আমিও। জল খাবে?

না, বমি পাবে।

=========

মল্লিকা চার্চের ভিতরে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছে। মাটির তিলক কেটে দিয়েছে, মাথায় জপ করে দিয়েছে, জলপোড়া তার বোতলে দিয়েছে। মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছে। ওই তিনবেলা স্নান করে পরিস্কার কাপড় পরে বলতে হবে। আর অন্য কোনো দেবদেবী পুজো করা যাবে না।

সব জানত আগে থেকেই মল্লিকা। কত মানুষের কাছে শুনেই না তবে এসেছে এখানে।

আবার গিয়ে বসল ঢিবিটার উপর। ইচ্ছা করছে না এখনই ফিরতে। যীশুবাবার মুখটা বড় করুণ। সারা গায়ে রক্ত। পেরেক পোঁতা। মল্লিকার দেখে কান্না পেয়েছে। ওভাবে কেউ মারে? মারার হলে গুলি কর, ফাঁসি দে। ওইভাবে কেউ মারে?

মল্লিকা চোখটা ওড়নার খুঁটো দিয়ে মুছল। ছায়াটা সরে গেছে। রোদটায় খুব কষ্ট হচ্ছে না। তবু মল্লিকা সরে এলো। একটা বড় অশ্বত্থ গাছ দেখেছিল রাস্তায়, ওই একটু দূরেই, ওর তলায় গিয়ে বসলে হয়।

মল্লিকা গিয়ে দেখল ওর নীচে একজন ঘুমাচ্ছে। আবার ফিরে এলো। একটা বাড়ির পাঁচিলের যতটুকু ছায়া ততটুকুতেই মাথাটা দিয়ে বসল। মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে কতবড় খাদান করেছে রে? সব ওই মাটিপোড়ার জন্য। কপালটায় মাটি চড় চড় করছে। চোখটা বন্ধ করে যীশুবাবার মুখটা মনে করল আবার। কি কষ্ট দুটো চোখে। কারা মারল? কেন মারল? মল্লিকা যীশুবাবার জন্য প্রার্থনা করল। কার কাছে করল? সেকি মেরী? সেকি যীশুবাবাকে পেটে ধরেছে? মল্লিকার বুকের মধ্যে থেকে কে যেন সাড়া দিচ্ছে। মল্লিকা যেন মা। মেরী। মনটা উদাস হয়ে গেল মল্লিকার। সব কাঙাল, অভাগা বাচ্চাগুলোর মা যেন সে।

গা’টা আবার গুলিয়ে উঠে বমি হল।

=======

স্টেশানে এসে বসল। কিন্তু শরীরটা ভীষণ অস্থির করছে। গা গুলাচ্ছে। বুকটা ধড়ফড় করছে। মাথাটা ঘোরাচ্ছে। কি করবে! অনেকক্ষণ খায়নি বলে?

মল্লিকা উঠতে যাবে মাথাটা ঘুরে গেল। চোখ অন্ধকার। আশেপাশে অনেকে কথা বলছে শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। শরীরটা ছেড়ে দিচ্ছে। কানের মধ্যে কেমন গোল্লা গোল্লা শব্দ আসছে। ট্রেনের ঘোষণা হচ্ছে। সবাই আসছে যাচ্ছে। সে কি শুধু চলে যাচ্ছে? একা? আবার একা?

কেউ মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে। আহা! আরাম লাগছে। কেউ তাকে ধরে বসাচ্ছে। প্রচণ্ড ঘামে সালোয়ারকামিজ ভিজে চাপচাপ হয়ে আছে। মাথাটা ইটের মত ভার হয়ে আছে। বসেছে, কিন্তু ঝাপসা দেখছে। কেউ জলের বোতল ঠেকাচ্ছে ঠোঁটে। কেউ জল তার ঘাড়ে, সারাটা মুখে বুলিয়ে দিচ্ছে।

কিছুটা জল খেল। একজন চায়ের ভাঁড় এগিয়ে দিয়ে বলল, খেয়ে নিন দিদি, ভালো লাগবে।

একজন মহিলা পাশে বসে, বলছে, অনেকক্ষণ খালি পেটে কি মা? চা-টা খেয়ে নাও গরম থাকতে। আর একটু মুড়ি খেও। সঙ্গে আছে আমার, দিচ্ছি।

মল্লিকার সারাটা মুখ জলে মাখানো। সেই জলের সঙ্গে মিশছে তার চোখের থেকে চুঁইয়ে নামা জল। মানুষকে কষ্টও দেয় মানুষ, মানুষকে সান্ত্বনা দেয়ও মানুষ। মানুষ ছাড়া যায় কোথায় মানুষ? ট্রেনের ঘোষণা হচ্ছে। আর দশ মিনিট পর ছাড়বে। যাক ছেড়ে। একা তো নয় সে। কিন্তু সবাইকে কি বলে কৃতজ্ঞতা জানাবে?

হাতটা জোড় করল। কার কাছে করল? যার কাছে যীশুবাবার জন্য প্রার্থনা করেছিল তার কাছেই করল। তাকে ঘিরে সে-ই দাঁড়িয়ে এতগুলো মানুষ হয়ে তার সামনে।

এখন ঠিক লাগছে তো…..

সে জোড়হাতে বলল, হ্যাঁ। পাশে বসা মহিলার হাতে একমুঠো মুড়ি। দেবে তাকে। মল্লিকা অঞ্জলির মত বাড়ালো হাত।