হাতের উপর অনেকগুলো রেখা। সব রেখা নদীর মত সমুদ্রে মেশে না। পরিণতি নেই। তবু আছে। রাত বলে দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকারে মিশে আছে। তবু অন্ধকারেই ভাগ্যের হাল ধরে রেখেছে। চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
এই ওঠ.... যাবি তো.. শালা মাল খেয়ে ঝিমাবি যদি রিকশা বার করেছিস কেন?
যাব তো। যাব না তো বলিনি। আমার রিকশার শরীর জুড়ে অন্ধকার। এদিকে স্ট্রিটলাইট সব ভাঙা। কারা যেন ভেঙে দিয়েছে। আরেকটু এগোও, দেখবে জুয়ার আড্ডা। মদের বোতল। মেয়েমানুষের শরীরের চর্চা। আদিরসের কথা। ওরা আলো সহ্য করতে পারে না। ভেঙে দিয়ে গেছে। বসুন, কোথায় যাবেন? ও, বসে পড়েছেন? কোথায় যাবেন?
সাহেব কলোনী....
চলুন, কুড়ি টাকা...
মাতাল শালা... তাই চল...
মাতাল নই.. তবু চলুন...আপনি জানেন সব রিকশাওয়ালারা মাতাল, দুশ্চরিত্র, বউকে মাল খেয়ে এসে মারে। আমি মাল বলি না। মদ বলি। মাল মানে বস্তু। আমি মাধ্যমিক পাস। আমি ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা জানি। আমি পর পর ভারতের প্রেসিডেন্টের নাম বলতে পারি। আমি ক্রিকেটের অনেকগুলো যুগান্তকারী স্কোর জানি। কিন্তু আপনি এসব শুনবেন না। আমিও বলব না তাই। আমার মুখে শীতকাল আর সুপর্ণা শুনলে আপনি সহ্য করতে পারবেন না। আপনার থিওরিতে আঘাত লাগবে। আপনারা বুদ্ধিজীবী মানুষ। থিওরিজীবী মানুষ। আপনারা বাস্তবের স্বার্থে আর জগতকে থিওরি আর আদর্শে দেখেন। আপনারা মৃত। নিজেরাও জানেন। শ্রীজাত'র রিকশাওয়ালা নিয়ে একটা কবিতা আছে। লাইনগুলো মনে নেই। কিন্তু আমায় কয়েক রাত কাঁদিয়েছিল কবিতাটা। ভাবটা এরকম ছিল, সব রিকশাওয়ালা সমুদ্র দেখতে চায়, কিন্তু সমুদ্রে যাওয়ার মত কোনো সওয়ারি পায় না। তারা সমুদ্র আসার আগেই নেমে পড়ে। আপনিও নেমে যাবেন। আমি কিছু বলব না। আমার এখন কোনো অভিযোগ নেই আর। ঈশ্বরের কাছেও না, ঈশ্বর আমার বগলের লোমের মত অদরকারি এখন, কাটি না তাই। আমার অভিযোগ নেই ভাগ্যের কাছেও। বাজেট পাশ হওয়ার আগেই আমায় কেউ জিজ্ঞাসা করে না টুথপেস্টের দাম কত হলে সুবিধা হয়, তো ভাগ্যস্রষ্টা আমায় জিজ্ঞাসা করবে? ধুর! তার চাইতে এই যে আমি একমনে রিকশা চালাচ্ছি, আপনি টাকা দেবেন বলে কিছুক্ষণ আপনার গোলামী করছি, আপনি এইতে নিজেকে সুখী করুন। আপনার সুখ থিওরিগত। আমি চ্যালেঞ্জ করতে পারি কোনো নারী আপনাকে সুখী করতে পারেনি, কারণ শরীর অহংকারীর কাছে নিজের রহস্য খোলে না। আপনি বিশ্রী অহংকারী। তার চাইতে আমার পাছার ওঠাপড়া দেখুন। আপনি সমকামী কি? যদি হন তবে বিকৃত বলব না, তবে আরো জটিল আপনার জীবন... কীটের মত অন্ধকার চুষে বাঁচেন।
থাম.. থাম...এইখানেই.. এই নে....
মেঘ ডাকছে। আপনি আমায় 'আপনি' বলবেন না। আমি জানতাম। আমার পোশাক, আমার চেহারা, রিকশার চালকের সিট - আপনাকে আমায় 'আপনি' সম্বোধন করতে দেবে না। আপনার শিক্ষায় লাগবে। আপনার অভ্যাসে লাগবে। মানুষের মধ্যে ঈশ্বর নেই। থাকলেও পচে মরে গেছে অনেকদিন হল। মানুষের মধ্যে থাকে অভ্যাসের চাকা। স্বার্থের স্পোক। লোভের তেল দিলে চোঁ চাঁ করে দৌড়ায়। আপনার টাকাটায় সুগন্ধ। কৃত্রিম সুগন্ধ।
বৃষ্টি শুরু হল। সওয়ারির সিট ফাঁকা। কাঁপতে কাঁপতে যাচ্ছে। সওয়ারির পাছার নীচে চেপে থাকা অভ্যাস। স্বাধীনতা পেলে বল্গাহীন হয়ে যায়। মুখ থুবড়ে রাস্তাতেও পড়ে যেতে পারে। হয়েছে অনেকবার। ধুলোকাদা মাখা হয়েছে। আবার পরিষ্কার করে লাগিয়েছি, ভদ্রমানুষদের কাচা পোশাককে রক্ষা করার জন্য।
ভাস্কর চক্রবর্তী বলেছিলেন, এইভাবে শুয়ে আর কদ্দিন থাকা যায়, পুরোনো প্রেমিকার স্মৃতি মনে করে বরং একটা সিগারেট ধরানো যাক। লাইনগুলো এলোমেলো হয়ে গেল। কবিতার লাইন ভালোবাসায় নিজের হলে এলোমেলো হয়ে যায়। হুবহু মুখস্থ রাখতে পারে যে সে বাচিক শিল্পী হয় কিম্বা মাস্টার কি ছাত্র হয়। এরা কেউ কবিতার প্রাণকে ছুঁয়ে বাঁচে না। কবিতার শরীরকে ছোঁয়। টাকা রোজগার কি নাম রোজগারের দায়ে। আমার কোনো দায় নেই। আমি একটা বিড়ি খাব। না, আজ সিগারেট। আজ আমায় কবিতায় ধরেছে।
দোকানি আড়চোখে তাকালো। এই অন্যমনস্ক স্বার্থপর একগুঁয়ে দোকানিও একজন রিকশাওয়ালার গলায় 'সিগারেট' শব্দটা শুনে তাকালো। ওই যে বলছিলাম, অভ্যাস। কি যাদু! এই স্বার্থমগ্ন মানুষটাকেও চমকে বাইরে বার নিয়ে এল, শুধু সিগারেট বলেছি বলে।
আমার রিকশাটা ভিজছে। আমার মুখে মদের গন্ধ খুঁজছে দু'জন নগরের বিবেকরক্ষক। সরে দাঁড়ালো। মানে মদের গন্ধ পেয়েছে। অথচ সব মদ আজ মদের দোকানে, আমার পেটে এক চামচও নেই। তবু পেয়েছে, শালা নিজেরা গিলে থাকলেও আজ নিজের মদের গন্ধই আমার মুখে পাবে। ওটাই থিওরি।
আমি আমার পুরোনো প্রেমিকার কথা ভাবব এখন। যে কোনোদিন ছিল না। আমার স্বপ্নে এসে ভাড়া খেটে যেত। একদিন ভালোবেসে ফেললাম। তারপর একদিন মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বললাম, এসো না। তার শাড়ি, সমস্ত অন্তর্বাস জানলা দিয়ে ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলাম, কেউ কথা রাখেনি কোনোদিন। এই কথা বুঝতে সুনীলকে জানতে হয়নি আমায়। জীবন শিখিয়েছে।
সিগারেট শেষ। আগুন জ্বলতে চাইলেও সিগারেট জায়গা দেয় না আর। সিগারেটের মাপ হয় অর্থনীতির নিয়মে। আগুন অর্থনীতি বোঝে না। তৃষ্ণার মত পুড়িয়ে বলে, আর নেই? মানুষ নিজেকে মেলে বলে, এই তো আমি, পুড়িয়ে ফেলো। মানুষ পুড়তে পুড়তে বাঁচে, বাঁচতে বাঁচতে পোড়ে।
আমি ঘুমাব এখন। আমার হাতের রেখারা জেগে থাকবে। নতুন অপমান, নতুন আশা, নতুন গল্প। সব কালকের জন্য। আমার লেখা কিছু কবিতা আছে। কেউ ছাপাবে না। আমিও চাইনা কেউ ছাপুক। আমার রিকশার হাতলের থেকে বাস্তব, আর প্যাডেলের থেকে বাধ্য কেউ নেই। আমি কাউকে বলি না, কাছে এসো। কবিতাকেও না।
সৌরভ ভট্টাচার্য
23 July 2020