রত্নামাসির যা ছিল অন্তর জুড়েই ছিল। রত্নামাসির দুটো ছোটোঘর জোড়া সংসার, স্বামী, দুটো বাচ্চা ছেলে, একটা খাট, একটা আলমারি, গ্যাসওভেন, একটা ড্রেসিংটেবিল, দুটো সাইকেল, একটা লেডিস, একটা জেন্টস - সব রত্নামাসির অন্তর জুড়েই ছিল। দুটো কি তিনটে বাড়ি কাজ করত রত্নামাসি। হাসিমুখ, বারবার পরা শাড়ি, মাটি ছুঁয়ে যাওয়া ঢালু হয়ে আসা চটি, একটা কালো ছাতা, কি একটা তেলের গন্ধ - এই তো রত্না মাসি।
শীতেরবেলা গেছি কয়েকবার। খোঁজ নিতে - কাজে এলে না কেন?
এই দেখো জ্বর। লাল বালাপোষ। তাতে নীল নীল ফুল আঁকা। টিভিটা বন্ধ। বন্ধ কাঁচে ছোটোঘরটার ছবি। রত্নামাসির যা কিছু ছিল অন্তর জুড়ে ছিল। এত বড় বড় বাড়িতে কাজ করে। সবাই বলে, লোভ নেই ওর। এত অল্পে খুশী। এত প্রাণখোলা হাসি। এত মানিয়ে নেওয়া যেখানে সেখানে, যখন তখন।
রত্নামাসির স্বামী ছেড়ে গেল। অন্য পাড়ার বউয়ের সঙ্গে কোথায় যেন গিয়ে ঘর বাঁধল। রত্নামাসি কম কথা বলে। যত দুঃখ, যত ব্যথা, কাউকে বলে না। শুধু হেসে বলে, কপাল! যত দুঃখ, যত যা কিছু রত্নামাসির অন্তর জুড়েই ছিল। কপাল যেন গোয়ালঘর। সারাদিন ধরে সব সুখ, দুঃখকে চরিয়ে রত্নামাসি সে সব নিয়ে যেন সে গোয়ালঘরে ঢোকে। সব সুখদুঃখকে যত্নে রাখে। তাড়িয়ে দেয় না। কিছু হারায় না।
রত্নামাসি, কাজে আসোনি?
জ্বর রে ভাই… চা খাবি? বানালাম এই... আয় না বোস….
বসলাম। রত্নামাসি দুঃখ কোথায়? দেখছি না যে?
রত্নামাসি আবার হাসে। বলে, দুঃখ আছে। কপাল থাকলে সবই থাকে। কপাল কি কাউকে শূন্য রাখে? তবে কি জানিস? মানুষ বড় বোকার মত হিসাব রাখে। দেখ, সে যত ভালো, দেখবি অন্যের কাছে তার চেয়েও ভালোর দাবি রাখে। আবার সে যত খারাপ, অন্যের কাছে তার চাইতে কম খারাপের দাবী রাখে। তাই কি হয়?
কথা ঘোরাচ্ছ? তোমার এখন অনেক বয়েস। আমিও অনেক বড় এখন। যা কিছু সব কোথায় আছে?
রত্নামাসি বলল হেসে, দেখ রে ভাই, যা কিছু আছে সবই আমার অন্তরজুড়ে আছে। যা দিয়েছেন ঈশ্বর আমায়, সুখদুঃখ, আঘাতকষ্ট - কি হবে সে সব হারিয়ে ছড়িয়ে। সব নিয়েছি বুকে করে। শূন্যে কি কেউ ঘর বাঁধে!
রত্নামাসির দিন ফুরালো। তেমন তো কেউ নয়! কেউ কেউ বলল, আহা! তার বেশি কি মনে থাকে কারো? তবু কেন যেন ভাবি, বারবার ভাবি, এত কিছু নিয়ে কেমন করে শান্ত ছিল মানুষটা যে! সে লাল বালাপোষ এখনও যেন চোখে ভাসে। নীলফুলগুলো এখনও যেন কি কথা বলে। রত্নামাসি হারিয়ে গিয়েও থমকে দাঁড়ায়। আমায় চেয়ে দুহাত নাড়ে। স্মৃতি বলে, রত্নামাসির যা কিছু ছিল, অন্তর জুড়েই ছিল।