লক্ষ্মী হাঁ করে জোড়হাতে প্রভুর রথের দিকে তাকিয়ে। লক্ষ্মীর কোল ঘেঁষে তার ছেলে বলরাম, ছ বছর বয়েস।
লক্ষ্মী মনে মনে বলল, হ্যাঁ প্রভু, তোমাকে বছর বছর দেখি একই রকম, ওরা তো দেখি কত রকম ভোগ রান্না করে তোমার জন্য… তোমার কি রুচি হয় না…. না গায়ে লাগে না?… আমার বলরামকে তো তেমন দুটো খেতেই দিতে পারি না…. কিন্তু তুমি?
========
লক্ষ্মী ঘুমালো। দরজায় এসে ধাক্কা দিল হাওয়া। লক্ষ্মী উঠে দরজা খুলল। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। হাওয়ার ধাক্কায় দুলছে দরজা। বলরাম ঘুমাচ্ছে। লক্ষ্মী প্রদীপটা জ্বালল। বলরাম ঘুমাচ্ছে। পাঁজরগুলো উঠছে পড়ছে, লক্ষ্মী পাঁজরগুলোর উপর হাত বুলালো। বাবা মরা ছেলে। কি খাওয়াবে? লক্ষ্মীর তো কোনো বাঁধাধরা কাজই নেই। ঘুঁটেগুলো যেখানে জড়ো করা, তার পাশে ঘুমাচ্ছে শাশুড়ি। হাঁটতে চলতে পারে না, চোখেও দেখে না।
লক্ষ্মী বসে বসে ঢুলছে আর স্বপ্ন দেখছে, তারা রোজ যাচ্ছে মন্দিরে। জগন্নাথদেব নিজে হাতে করে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে বলরামকে, শাশুড়িকে আর তাকে।
======
দরজায় আবার ধাক্কা দিল কেউ। ঝড়ের হাওয়া। বৃষ্টি মাখা হাওয়া। লক্ষ্মী দরজা খুলল।
বাইরে দাঁড়িয়ে জগন্নাথ। একটু দূরে রথ। বলল, সুভদ্রা, বলরাম ঘুমাচ্ছে… একটু কিছু খাবার হবে? আসলে অনেকটা রাস্তা যাব। সঙ্গে কিচ্ছু নেই।
লক্ষ্মী বলল, দাঁড়ান। ঘরে যেটুকু চাল আলু ছিল বার করে একটা থালায় সাজাতে যাবে, হাত থেকে পড়ে গেল থালা। ঝনঝন করে বেজে উঠল। বলরাম উঠে বলল, কে মা? তুমি কি করছ ওখানে? শাশুড়িও উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে। লক্ষ্মী অবাক হল, শাশুড়ি বলল, বউমা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কে, প্রভু?
লক্ষ্মী বলল না কিছু। বাইরে এসে দাঁড়ালো। জগন্নাথের সঙ্গে সঙ্গে গেল। হাওয়ায় ভাসা পালকের মত ভেসে চলেছেন প্রভু। রথের এক পাশে থালাটা রাখল। বলল, এই আছে প্রভু।
জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা তাকালো। কিন্তু তার দিকে নয়। তার পিছনে কাকে দেখছে?
লক্ষ্মী মাথা ঘুরিয়ে দেখল তার বলরাম আর শাশুড়ি দাঁড়িয়ে।
জগন্নাথ বলল, তোমার বলরাম যাক আমার সঙ্গে? ঘুরে আসুক।
লক্ষ্মী বলল, খবরদার না। একদম না।
সুভদ্রা বলল, বেশ শাশুড়ি না হয় যাক…..
লক্ষ্মী ভাবল। শাশুড়ির দিকে তাকালো। শাশুড়ি তার দিকে তাকিয়ে। মাত্র ক'টা হাড়। শরীরটা নারকেলের ছোবড়ার মত শুকনো। জিভটা বারবার বাইরে বার করছে। শুকনো জিভ। যাবে প্রভুর সঙ্গে ওপারে?
লক্ষ্মী বলল, থাক…. যে বাড়ি কাজ করি, বলেছে চালের গুঁড়ো দেবে, বাগানের সব ঘাস কেটে দিলে। ওকে পিঠে বানিয়ে খাওয়াব। তার আগে না।
জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল ওরা ঘরের দিকে যাচ্ছে। একটা ছোটো কুঁড়ে ঘর। মাটির। তার ভিতরে মাটির প্রদীপের শিখা কেঁপে কেঁপে জ্বলছে।
সুভদ্রা বলল, ওরা কিসের টানে ফিরছে? কার কাছে ফিরছে?
জগন্নাথ বলল, জীবনের টানে ফিরছে…. ওদের যা আছে… আমাদের যা নেই…. জীবন।
থালায় রাখা চাল আর আলু ততক্ষণে সোনার হয়ে গেছে। তাতে আকাশ জোড়া তারার ছবি পড়েছে এসে। কিন্তু কি নেই? বলরাম বলল, মাটির গন্ধ নেই।
ততক্ষণে লক্ষ্মীর বলরাম, লক্ষ্মীর শীর্ণ বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে। শাশুড়ির দুটো চোখে জলের ধারা। কে বলবে সুখে, না আফসোসে?