Skip to main content

এমনিতে ট্রেনে আমার ঘুম হয় না কোনকালেই। রাতের ট্রেন। পদাতিক এক্সপ্রেস। উপরের বার্থে শুয়ে। স্লিপার ক্লাস। মে মাস, ভীষণ গরম। জেগেই আছি। বিভিন্ন রকম শব্দ কানে কন্সার্ট তৈরি করে চলেছে। রাতের ট্রেনে সব সময়ই একটা অন্য জগতের রোমাঞ্চকর অনুভূতি হত আগে আমার। ইদানীং আর হচ্ছে না। অন্ধকারের মধ্যে এতগুলো ঘুমন্ত মানুষ। অনেক কিছু ঘটতে পারে জেনেও চলেছে গন্তব্যে। অদৃষ্টকে আর হিংসার রাজনীতিকে তোয়াক্কা না করেই - 'হতে তো পারে অনেক কিছুই, তবু যাব।'
     মাঝে মাঝেই খবরের কাগজে, টিভিতে দেখা ঘটনাগুলো আজকাল রাতের ট্রেনে চোখের সামনে ভীড় করে আসে। যা ছোটবেলায় কেন, এই সেদিন অবধিও হত না। আগে মানুষ যত নিশ্চিন্তে ট্রেনের দুলুনিতে রাতের ঘুমে ডুবে যেতেন, আজ পারেন কি? মনে হয় না। জনবাহী ট্রেনের আগে যায় পাইলট ট্রেন। কেন? না কিছু মানুষ তাদের প্রাণের বিনিময়ে নিজেদের আদর্শ স্থাপন করতে চাইতে পারে।
     রেললাইনে রাখতে পারে বোম, কেটে রেখে যেতে পারে রেলপথ। মুখ থুবড়ে ছিটকে পড়বে বহু নিরীহ-প্রাণবাহী একটা যান। রক্তাক্ত হবে চারপাশ, অসহায় কান্না উঠবে, আর্তনাদ উঠবে। কিছু মানুষ বলবে," আমি আনন্দিত"।

     আমার এরকম বিচিত্র এক বোকা বোকা (এখন ভাবলে লাগে, তখন লাগে নি) অভিজ্ঞতাই হল সে রাতে পদাতিকে এক্সপ্রেসে।
     আমি আছি কূপের মধ্যে আপার বার্থে। আমার উল্টোদিকে সোজাসুজি সাইড আপার বার্থে একটা বড় ব্যাগ রাখা। অথচ কাউকে দেখছি না অনেকক্ষণ হল। আমার মনে হাজার সংশয় ঘোট পাকতে শুরু করল। বোম নেই তো?
     নিজের উপর খুব রাগও হচ্ছিল। কেন ভাবছি এসব? বোম কেন হতে যাবে? যত উপেক্ষা করতে যাই তত অস্থিরতা বাড়তে লাগল।
     সংশয় আরো দ্বিগুণ হল তার কিছুক্ষণ পর। যখন থাকতে না পেরে নীচের সীটের ভদ্রলোক জেগে আছেন দেখে ওনার কাছেই জানতে চাইলাম উপরের ব্যাগটা কার?
     তিনি বললেন ব্যাগটা যার তিনি প্রায় আধঘন্টার উপর হল সামনের বাথরুমে গেছেন। এখোনো বেরোন নি। খটকা লাগল। সামনের বাথরুমে গিয়ে দেখি একটা চার্জার প্লাগে লাগানো আর তার তারটা বাথরুমের ভিতর চলে গেছে। দরজা বন্ধ না ভেজানো বুঝলাম না।
     আমার রীতিমত ঘাম দেওয়ার মত অবস্থা। বাথরুমে কথা কেন? ভাবলাম একবার বন্ধুদের তুলে ঘটনাটা বলি, না হয় বোকাই বনব। তারপর ভাবলাম থাক। বরং হাঁটি। আরেকটু দেখি।
     দুটো কামরা পর কিছু ছেলেরা জটলা করে গল্প করছে দেখলাম। ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। জানলাম ওরা দিনমজুরের কাজ করে বোম্বেতে। উত্তরবঙ্গেই বাড়ি। ফিরছে। দু'জনের সীটে পাঁচ জন। তাই ওরা গল্প করেই কাটাবে ঠিক করেছে। একজন বলল, "বস দাদা, ভুতের গল্প হচ্ছে, হেব্বি জমে গেছে।" আমি একটু বসেই উঠে আসলাম, ওদের কোন কথাই কানে ঢুকছে না। শুধু মনে হচ্ছে, কে হতে পারে? এতক্ষণ বাথরুমেই বা কেন?
     ফিরে এসে দেখি বাথরুম ফাঁকা। চমকে উঠলাম। তবে?! আমাদের কূপটার কাছে এসে দেখি, উনি ওনার সীটে শুয়ে আছেন। আমি আমার বার্থে শুয়ে ওনাকে খেয়াল করতে লাগলাম।
     প্রায় ছ'ফুট উচ্চতা হবে মানুষটার। বয়স তা পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্নর মধ্যে হবে। সাদা কুর্তা আর পায়জামা পরা। ধবধবে সাদা গায়ের রং, একমুখ দাড়ি। বাথরুমের কাছেই আমাদের সিটগুলো থাকায় দরজার কাছে জ্বালা আলো ওনার মুখে পড়ছিল। একটা রুমাল দিয়ে ঢাকলেন মুখটা।
     দশ-বারো মিনিট পরেই আবার উঠলেন। উঠেই পাশের ব্যাগ থেকে দুটো মোবাইল বার করলেন। আবার নেমে বাথরুমের দিকে গেলেন।
     আমার এবার সত্যিই বেশ ভয় লাগতে শুরু করেছে। আমি ধীরে ধীরে নামলাম যাতে বন্ধুরা টের না পায়। নেমে বাথরুমের কাছে গিয়ে দেখি সেই এক ছবি - চার্জে গোঁজা মোবাইলের তার। মোবাইল ভিতরে।
     আমার এবার মনে হল পুলিশকে জানানো দরকার। সারা ট্রেনে একজন পুলিশও নজরে এল না। হাঁটতে হাঁটতে আবার সেই ছেলেগুলোর কাছে এসে পড়লাম। ওরা আমার মুখ দেখে কিছু সন্দেহ করেছিল বোধহয়। বলল, "কিছু প্রবলেম দাদা? টেনশানে আছেন মনে হচ্ছে?"
     আমি থাকতে না পেরে কিছুটা বললাম। ওরা বলল, "ঠিক আছে দাদা। আমরা জেগেই আছি, কিছু সমস্যা বুঝলেই বলবেন।" আমি "আচ্ছা" বলে আরো এগিয়ে গেলাম সামনের কামরাগুলোর দিকে।
     ঘুমন্ত ট্রেন। অকাতরে ঘুমিয়ে সব। কি বিশ্বাসে - ভাগ্যে? না ভগবানে? না অসহায়ের মত 'যা ঘটছে ঘটুক আমরা কি করতে পারি গোছের আত্মসমর্পণ?' জানি না।
     একটা খোলা দরজায় এসে দাঁড়ালাম। গভীর রাতে বিস্তীর্ণ জনশূন্য মাঠের মধ্যে শতাধিক নিরীহ ঘুমন্ত মানুষ নিয়ে ছুটছে ট্রেন। অসহায়ের মত লাগছিল। হয় তো কিছুই ঘটবে না। কিন্তু ঘটে তো এরকমভাবেই। এক লহমায় শেষ হয়ে যায় সব। পরের দিন কয়েক ঘন্টার জন্য শুধুই ব্রেকিং নিউজ আর উদ্বায়ী প্রতিয়াশ্রুতির ভিড়।

     ফিরে এসে শুলাম। যা হয় হোক।

     এন জি পি তে যখন নামলাম বেশ ক্লান্ত লাগছিল। ওভারব্রীজ দিয়ে উঠছি। দেখলাম সামনে সেই ভদ্রলোক। খুবই লজ্জা পেলাম। ক্ষমা চাইলাম মনে মনে।
তবু একটা যন্ত্রণা বিঁধেই রইল বুকের মধ্যে। এভাবেই কি বাঁচব আমরা? আতঙ্কে, সংশয়ে, ভয়ে ভয়ে! মানুষের হাত থেকে মানুষকে পরিত্রাণ কে দেবে? কেউ কি দিতে পারে?
     জানি না, নাকি সেই আশ্বাস-
    "মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি।"(সভ্যতার সংকট)