সৌরভ ভট্টাচার্য
28 February 2019
"ফিরব না এখন", বললাম।
"বুঝলাম, কিন্তু আমি দুটোর বেশি ট্রেন মিস করব না।"
বললাম, "ঠিক আছে।" বিশ্বাস করলাম না।
নীলরঙের চুড়িদার, চুলটা একহাতে কপাল থেকে সরিয়ে ডানহাতে ঘড়িটা দেখল। মনে মনে বললাম, নক্সা!
স্টেশানে এসে বসলাম। প্রচণ্ড মেঘ করেছিল সকাল থেকে। বসতে না বসতেই ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। পা'দুটো গুটিয়ে চেয়ারের তলায় ঢুকিয়ে নিল। লাল রঙ করা নখগুলো। পা'দুটো শঙ্কুর মত সামনের দিকটা সরু, যে চটিটা পরে আছে কলেজের প্রথম দিন থেকে এটাই পরে কাটিয়ে দিল। ওর বাবার মিল বন্ধ। আমাদের বাড়িতে অনেকেই মিল বন্ধ বলে সাহায্য চাইতে আসত, আমি ওর মুখের সাথে অনেকের মুখের মিল খুঁজতে চেয়েছি, পাইনি।
একটা একটা লোকাল ট্রেন সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। ছাদের উপর মুষলধারে বৃষ্টি পড়ে ঝরণার মত চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমি ঝরণা দেখেছি, ও দেখেনি, পুরী ছাড়া যায়নি কোথাও। ওর জামা থেকে একটা পুরোনো, না কাচা গন্ধ আসে। আগে অস্বস্তি হত, এখন ভালো লাগে।
লাইনের দিকে তাকিয়ে বসে। আমি উঠে দুটো বাপুজি কেক কিনলাম। একটা ওর ব্যাগের উপর রাখলাম। ব্যাগটা কোলে রেখে বসে। হাতদুটো একসাথে জড়ো করা। হাতের আঙুলে রঙ নেই। আঙুলগুলোর মধ্যে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই, এমন কাছাকাছি জড়োসড়ো করে আঙুলগুলো রাখা।
ফর্সা মানুষ দেখলে আমার একটা কি নেই কি নেই মনে হয়। যেন প্রাইমার মাখিয়ে রঙ করতে ভুলে গেছে, ওকেও তাই লাগে। যেন সারা শরীরে রক্তও নেই, থাকলেও সাদা। শুধু ঠোঁটদুটো লাল। অসহ্যরকম লাল। দম আটকানো লাল। মাথা-কান গরম করা লাল। কিন্তু আমি কোনোদিন চুমু খাইনি। চেয়েছি, এই মুহূর্তেও চাইছি। প্রচণ্ড ভিড় স্টেশানের মধ্যেও আমি একা দাঁড়িয়ে, ভীষণ শক্ত করে জড়িয়ে, চুমু খেতে চাইছি। আগে কৌতুহল ছিল। এখন তেষ্টা। চুমুর তেষ্টা। বলতে চেয়েছি, পারিনি। ওরা দীক্ষিত। বাড়ির সবাই দীক্ষিত। ভগবান আর গুরু চুমু খাওয়া পছন্দ করে না। গুরুদের কাছে চুমু মানে কাম, সেক্স। ভালোবাসা মানে চুমু নয়। ভালোবাসা মানে করুণা। কিন্তু আমি তো তোকে করুণা করি না, ভালোবাসি। ভালোবাসা মানে শুধু চুমু না, দেখতে না পাওয়ার কষ্ট, গায়ের গন্ধ না পাওয়ার কান্না, চোখের মণিতে চোখ না রাখতে পারার দমবন্ধ অবস্থা।
কেকটার প্যাকেটটা খুলে বাঁহাতে মুড়ে ধরে আছে। ডাস্টবিন না হলে ফেলবে না। ওর ঘরে একটা চৌকি পাতা আছে। বাঁদিকে একটা সস্তা বইয়ের র্যাক। আলনায় ওর বাড়ির সবার জামাকাপড়, ডানদিকে ওরগুলো, কি জীবন্ত! ওর শরীরের মত।
সামনের দিকে তাকিয়ে কেকের একটা টুকরো মুখে পুরে চিবাচ্ছে। ওর কানের পাশের চুলগুলো চোয়ালের নাড়াচাড়ার সাথে নড়ছে, ওর খাওয়া দেখলে আমার কান্না পায়। ওদের অবস্থার জন্য করুণায় না, নিজের অসহায়তার জন্য। আমার জলের বোতলটা বাড়িয়ে দিলাম। বলল, "পরে, নিজে খা।"
ইতিমধ্যে তিনটে ট্রেন বেরিয়ে গেছে। আমাদের গন্তব্য দু'দিকে। ও যাবে ডাউনে, আমি আপে।
হাতের উপর হাত রাখলাম। ঠাণ্ডা হাত। বলল, "আমার হয়ত গ্র্যাজুয়েশান করাটা হবে না।"
আমি জানি। ওর ছোটোমাসির দেওরের সাথে বিয়ের কথা চলছে। আমি বিশ্বাস করতাম না। পালিয়ে যাব? কোথায় যাব? পাড়ার মুদির দোকানে গেলেও বাড়িতে বলে যেতে হয়, কোথায় পালাব? হয় না। কিন্তু বিয়েটা তো আটকানোই যায়। না-ই করা যায়।
দেরি হয়ে যাচ্ছে মনে হল। মিথ্যা ট্রেন ছেড়ে বসে আছি মনে হল। এই তো রোগা প্যাঁকাটির মত শরীর... তাও কি দেমাক... না বসলেই হয়... না তাকালেই হয়...
ট্রেনের গোলমাল শুরু হল। কোনো স্টেশানে অবরোধ। বললাম, "চল, এর পরে অটোও পাওয়া যাবে না।" বাসে উঠলে ওর বমি হয়।
অটোতে উঠতে যাব, বলল, "তুই বাড়ি যা, তুইও পাবি না এরপরে, আমি চলে যেতে পারব।"
আমার ছাতা ছিল না। একটা ছাতায় অটোস্ট্যান্ড অবধি আসতে আসতে ভিজে গেছি। আমার সারা গা যেন এইটুকু রাস্তা আসতেই ওর গায়ের গন্ধে ভরে গেছে। আমার মনের মত। জেদ চেপে গেল, বললাম, "নক্সা করিস না, সরে বোস, উঠব।" কুড়ি মিনিট আমি বসব। পাশেই বসব। যা থাকে থাক ভবিষ্যতে। এই সময়টুকুতে তো ভবিষ্যত নেই। কোনো মাসির মোটা মাইনের দেওর নেই!
অটো ছাড়ল। আমার ডান দিকে ও, বাঁদিকে মোটা মাঝবয়েসী মহিলা একজন। মাঝরাস্তায় দু'জন হিজড়ে উঠল। ড্রাইভারের দু'পাশে বসল। কেউ কোনো কথা বলছিলাম না এতক্ষণ। হিজড়ে দু'জন বেশ জোরে কথা বলতে শুরু করে দিল। আমার একটা আড়ষ্টভাব কাটল। ওর দিকে ফিরে বললাম, "বিয়েটা আটকা!" গলায় দলা পাকালো বাপুজি কেকের গন্ধ। ও চুপ করে বৃষ্টির ছাঁট আটকানো প্লাস্টিকটা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল। সরু ঘাড়ের উপর কয়েক বিন্দু বৃষ্টির জল লেগে। একটু পরে ঝরে যাবে ওরা ঘাড় থেকে, কিম্বা শুকিয়ে যাবে ওর শরীর থেকে। আমার করুণা হল, বৃষ্টিবিন্দুর জন্য। ভীষণ করুণা হল।