পা হড়কে পড়ে যাচ্ছিল। রাস্তাটা ঢালু ছিল বলেই। নিজের পা। নিজেকেই সামলে নিতে হয়।
নৌকায় বসল। আরো জনা ছয়েক লোক না হলে ছাড়বে না। যতীন বিড়ি ধরালো। সকালটা কেমন নিস্তেজ। মানুষজন দেখলে ভাল্লাগে না। গা পাক দেয়। কি হল যতীন তোমার? চোখের নীচে কালি। জিভে স্বাদ নেই। মেয়েমানুষেও না। বিষাক্ত সব। গোটা সংসার বিষ। যৌবনে বোঝা যায় না। বুঝতে গেলে চল্লিশের উপর বাঁচা লাগে।
মেঘ নেই আকাশে। দেখতে দেখতে আরো দু’জন হল। মুখ চেনা। কথা বলে না। চম্পা পালিয়ে যাওয়ার পর তো আরো বলে না। লোকে বলে চম্পার নাকি পেট হয়েছে, আশ্চে পুজোতেই বাচ্চা হবে। যতীনেরই দোষ তবে। না মরদ শালা।
যতীন জামাটা টানটান করে নিল। রোজ দাড়ি কাটে। নাকের, বগলের লোম কাটে। এগুলো বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করার আগেই জামাপ্যান্ট পরে রেডি। আগে আগে তার সাজ দেখে লোকে ভাবত কলকাতায় যাচ্ছে। সে ভুল ভাঙিয়ে বলত, আরে ভাই সেলুনেই যাচ্ছি।
========
আজ কৃষ্ণনগর যাচ্ছে। জামাইবাবু মেয়ে দেখেছে। বয়েস বত্রিশ। বিধবা। বাচ্চাকাচ্চা নেই। হবেও না। সেও চায় না। মেয়েটার নাম সঞ্চারী। মানে কি? কে জানে। লক্ষ্মীর আরেকটা নাম হবে হয় তো। শুনেছে তো পুজোর সময় জন্মেছিল।
ট্রেন থেকে নেমে টয়লেটে গেল। পায়নি তেমন। প্যান্ট আর জামাটা ঠিক করতে হবে। করল। তারপর চিরুনিটা বার করে চুলটা আঁচড়াতে আঁচড়াতে বুকের পাটায় কেমন ব্যথা লাগল। চম্পার চুলের গন্ধ মনে পড়ল। মেয়েটা ভালো ছিল। খুব চঞ্চল, আর বুদ্ধি কম। নইলে ভালো।
========
আপনি বিয়ে করতে চাইছেন কেন?
সঞ্চারী তার চোখের দিকে তাকিয়ে। হলুদ শাড়ি পরেছে একটা। চোখ কটা। বেশ পরিষ্কার গায়ের রঙ। ঠোঁটে নীল লিপস্টিক।
যতীন বলল, বাড়িটা ফাঁকা লাগে ভীষণ। একজন তো কাউকে চাই।
আমার আগের স্বামী ট্রেনে কাটা পড়ে মরল। মাল খেত। তুমি ওসব খাও?
মাঝে মাঝে।
আমিও....
যতীন জানে অনেক মেয়ে মাল খায়। কিন্তু মাল খাওয়া বউ? চম্পা বমি করে দিত মালের গন্ধে।
সঞ্চারী বলল, ভয় নেই, মাতলামি করি না। আমার সত্যিকারের নেশা বলতে চা। দুধ চা। অনেকবার খাই।
যতীন সঞ্চারীর দাঁতের দিকে তাকালো। ভালো না। শরীরের গড়ন, থলথলে। বয়েস যা বলেছে তার চাইতে বেশি।
চা দিয়ে গেল সঞ্চারীর ভাইবৌ। সঙ্গে সিঙ্গাড়া আর মিষ্টি।
সঞ্চারী সিঙ্গাড়া তুলে নিল এক হাতে। আরেক হাতে চা। সিঙ্গাড়ায় কামড় বসিয়ে বলল, নিন, পটকার মাল... হেব্বি!
আপনি কেন বিয়ে করতে চাইছেন? যতীন আমতা আমতা করে বলল।
সঞ্চারী বলল, দেখুন আমার তো আপনার মত মিথ্যা কথা বলার অভ্যাস নেই... আর বাড়ি ফাঁকা লাগে বলাও যাবে না... আমি সত্যি কথা স্পষ্ট করে বলি.... আমরা দু’জনেই মানুষের রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ.... তাই আমি যে কারণে এসেছি... আপনিও.... আমরা রক্ত ছাড়া থাকতে পারব না।
যতীন থতমত খেয়ে গেল। কান গরম হয়ে যাচ্ছে। যেন ল্যাংটা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে মেয়েটার সামনে। সঞ্চারী সিঙ্গাড়া চিবাতে চিবাতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে।
যতীন চায়ের কাপ তুলে নিল, বলল, আপনি ভীষণ সাহসী।
======
বাড়ি ফিরে জামাইবাবুকে ফোন করে বলল, তার দু’দিন সময় লাগবে।
আসলে দু’দিন কেন, কোনোদিনই জানবে না সে ঠিক কি চায়। ফোন অফ্ করে তারাপীঠ চলে গেল। ফিরবে না কদিন এখন।
তারাপীঠে গিয়ে মদে চুর হয়ে কাটালো ক’দিন। মন বলল, সে যা চায়, সে সঞ্চারী নয়। সেও বাঘ, মানুষের রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ। কিন্তু চম্পার চুলের গন্ধ? চম্পা কি শুধুই রক্ত? সঞ্চারী বুঝবে না।
========
চারদিন পর জামাইবাবুকে ফোন করতে জামাইবাবু বলল, সঞ্চারী আগেই না করে দিয়েছে।
যতীন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সঞ্চারী কি তাকে কাপুরুষ ভাবল? সঞ্চারীকে ফোন করল। ব্লক করা। হোয়াটসঅ্যাপ, ব্লক করা।
যতীনের মাথাটা গরম হয়ে গেল। চম্পার বরের নাম্বারটা ছিলই। মিষ্টির দোকানের মালিক। যতীন ফোন করল, মদে বেসামাল অবস্থাতেই। মুখে যা এলো বলে গেল। অনেক কথা বলার পর একজন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কিন্তু মালিক তো নেই.... বৌদিমণি বিষ খেয়েছে.... ওরা সব হাস্পাতালে....
যতীনের নেশা ভাঙল যখন বেলা এগারোটা। এখনও তারাপীঠেই সে। চম্পা হাস্পাতালে? বিষ খেল? কেন? একটা গর্ববোধ হল। কিছুক্ষণ। মুহূর্তে আতঙ্কে ছেয়ে গেল মন। মরে গেছে? ফোনটা হাতে নিল। সে কি চায়? চম্পা বাঁচুক? না মরুক?
ফোন সুইচ অফ্ করে দিল। আজ মায়ের মন্দিরে যাবে। মদের ওখানে না। আজ পুজো দেবে।
স্নান করল। রাস্তায় বেরোলো। কিন্তু মন্দিরের রাস্তায় পা এগোলো না। মদের দোকানে কখন ঢুকে গেল, নিজেও খেয়াল করতে পারল না। যখন খেয়াল হল, তখন রাস্তায় পড়ে, এক আকাশ তারা। সবাই যেন রাস্তা হারিয়েছে, তার মত।