সৌরভ ভট্টাচার্য
2 January 2018
‘দেশ’ পত্রিকার এবারের সংখ্যাটা হাতে পেলাম। রামকৃষ্ণদেবের অপূর্ব একটা ছবিতে মন আটকালো। লেখাগুলো মন দিয়ে পড়লাম। প্রথম লেখাটা নিয়ে কিছু বলার নেই, অর্থাৎ মার্টিন কেম্পশেনের লেখাটা, কথামৃতের অনুবাদ সংক্রান্ত।
পরের লেখা দুটো ভাবালো। রামকৃষ্ণদেবের ছবি বাঙালী পরিবারে জন্মসূত্রে ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছি। মাঝখানে মা-কালীর দু’পাশে রামকৃষ্ণ, সারদাদেবী আর সামনে বিবেকানন্দ। বাবা প্রণাম করে অফিস বেরোতেন। মা স্নান করে প্রণাম করতেন। তারপর ঠাকুমার লেজুড় হয়ে থাকার সুবাদে বাংলা সিনেমায় রামকৃষ্ণের চরিত্রায়ণ দেখলাম। বুঝলাম ঈশ্বর এক, এই ওনার সব চাইতে বড় উপলব্ধি – যত মত তত পথ। তারপর স্কুলের কর্মশিক্ষা পরীক্ষায় প্লাস্টার অব প্যারিসে সবচাইতে পপুলার ছিলেন রামকৃষ্ণদেব। তাই লাগানো হল। শিক্ষক জিজ্ঞাসা করলেন, ইনি কেন বিখ্যাত ছিলেন? উত্তর দিলাম, যত মত তত পথ বলেছিলেন। কিন্তু সেইটা উপলব্ধি করে জগতে যে কি উপকার হল তা বুঝিনি। শিক্ষক বললেন, শুধু তাই নয়, তিনি মা কালীর দর্শন পেয়েছিলেন। সেই কথা শুনে যতটা না শ্রদ্ধা জন্মালো, তার চাইতে বেশি জন্মালো কৌতুহল।
তারপর পড়াশোনা বাড়ল। ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি নানা বিষয়ে। অবশ্যই আউট অব সিলেবাসের পড়া সেগুলো, কারণ নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। সেদিন পড়েছিলাম, রামকৃষ্ণদেব ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’ করেছিলেন; আজও ‘দেশ’-এ সেই কথাটার উপরেই সব চাইতে বড় জোর দেখলাম। সেদিনও বুঝিনি, আজও বুঝলাম না, তাতে কি লাভ হল? কথামৃত ভারতের নানা ভাষায় অনূদিত হল, প্রচুর রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা-উপশাখা খোলা হল। কত বড় বড় নামধারী শিক্ষিত কৃতী সন্তানেরা সন্ন্যাসী হল, কত লেকচার হল, কত অধিবেশন হল, কত বই লেখা হল, কত সেই বইগুলোর উপর বই লেখা হল...
তাতে কি হল?
ভারতের আজকের অবস্থানটাই কি তার যথেষ্ট নিষ্ফলতার প্রমাণপত্র নয়? কতগুলো দাঙ্গা হয়ে গেল ধর্মের নামে। আজও কত জায়গায় গনগনে আগুনের তাপ - ফুঁসছে সব। সলতে পাকানোই আছে, শুধু ফুলকির অপেক্ষা। কোথায় ‘যত পথ তত মত’-এর নমুনা? সেকি শুধু পাণ্ডিত্যের আর লেকচারের বিষয়? তবে গোলমালটা কোথায় হল?
অনেকেই দোষটা রাজনীতির ঘাড়ে চাপিয়ে দায় এড়াতে চাইবেন। কিন্তু অতটা সরলীকরণের জায়গায় দাঁড়িয়ে কি আমরা? নয় তো। গোড়ায় গলদটা তো রয়েই যাচ্ছে। সেটা কি?
প্রথম কথা, ধর্মে কি কোনোদিন সমন্বয় সম্ভব? এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ দুটোই। যা লালন পারেন, কবীর পারেন, সেই অর্থে রামকৃষ্ণ ব্যর্থ হন। তার কারণ, রামকৃষ্ণ যতই পৃথক ধর্মমত প্রবর্তন না করে থাকুন, কিন্তু তাঁকে নিয়ে একটা সম্প্রদায়, ‘মিশন’ তৈরি হয়েছে। একটা সম্প্রদায় ‘সব সম্প্রদায়’ সমান প্রচার করতে পারেন, কিন্তু সেটার জ্বলন্ত প্রমাণ হতে পারেন কি? হতে পারে সেখানে খ্রীষ্টানের মত পঁচিশে ডিসেম্বর, বৌদ্ধের মত বুদ্ধপূর্ণিমা, প্রাচীন হিন্দুর মত দূর্গাপূজা ইত্যাদির প্রচলন আছে; তাতে করে পাঁচমিশালি একটা সংস্কৃতি হয়, যার কোনোটাই আসল নয়, কিম্বা কোনটা আসল এই প্রশ্নে মানুষ বিভ্রান্ত হয়; কারণ সবক’টাই যে ‘মতো’, আসল তো নয়। যে খাঁটি খৃষ্টান সে চার্চে যাবে, যে খাঁটি মুসলিম সে মসজিদে যাবে, সে কেন বেলুড়ে যাবে? সময় কাটাতে, কৌতুহল মেটাতে, বা একজন দু’জন হয়ত বা আসতে পারেন, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সেটা একটা ‘মতো’, আসল নয়।
রামকৃষ্ণদেব কি তাই চাইতেন? তার নামে মন্দির হয়ে এরকম একটা পাঁচমেশালি কিছু হোক? সর্বোপরি তিনি কি রামকৃষ্ণ মিশন চাইতেন? মনে হয় না। আমি কোনো মিস্টিক তথ্যে যাচ্ছি না। কিন্তু তিনি কোনোদিন এই সব তিথি পালনের মাধ্যমে খুব সরলীকরণের মাধ্যমে ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’-এর বার্তা পৌছাতে চেয়েছিলেন? এটা কিরকম সেই রাজনৈতিক কৌশলের মত না? রামকৃষ্ণদেব কিন্তু এরকম কোনো বাহ্যিক সমীকরণে বিশ্বাসী ছিলেন না। এমনকি তাকে মার্কেটিং করতে যে এই ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’-এর ব্র্যাণ্ড করা হয়, এটা সারদাদেবীরও খুব অপছন্দ ছিল। তিনি বলেছেন, কোন মতলব এঁটে উনি এগুলো করেননি, ওটা হয়ে গিয়েছিল, ওনার প্রধান শিক্ষা ছিল ‘ত্যাগ’।
মিশন কিন্তু সে পথে হাঁটেনি। তারা আমাদের মন্ত্রীদের মত বড়দিনে যীশুর ফটো, শঙ্করাচার্যের জন্মদিনে শঙ্করাচার্যের ফটো, আর বুদ্ধের জন্মদিনে বুদ্ধের ফটো টাঙ্গিয়ে উৎসব করার চেষ্টা করে আসছে। পাশাপাশি কালী-দূর্গা-সরস্বতীও চলছে। আমাদের বোঝানো হচ্ছে, এটাই রামকৃষ্ণদেবের ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’; কিন্তু তিনি এত সস্তা পথে হেঁটেছিলেন কি? না। রামকৃষ্ণ মিশনের স্টলে আপনি কোরাণ, বাইবেল, ত্রিপিটক পাবেন কি? না। কারণ রামকৃষ্ণ ‘অবতার-বরিষ্ঠায়’, অর্থাৎ সুপারলেটিভ ডিগ্রি লেগে গেল। তিনি সব অবতারের ফুল প্যাকেজ, প্রচারিত হতে শুরু হল; এমনকি তিনি সব দেব-দেবীর মূর্তির প্রকাশ – তাও প্রচারিত হতে শুরু করল। অর্থাৎ আমাদের বোঝানো হচ্ছে, একটু ঘুর পথে, কে শ্রেষ্ঠ বুঝে নাও। সুবিধা করে দিল কথামৃত – আকবরী আমলের টাকা এখন চলে না, এখন ফিভার মিক্সচার, পাঁচন না – ইত্যাদি উপমারাই রামকৃষ্ণের শিক্ষার উপর পুরো পাথর হয়ে বসল। শেষ পেরেকটা মারল রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষা পদ্ধতি। সেখানে যতই সর্বধর্মের সমন্বয়ের গল্প শোনানো হোক, মন্ত্র হয় রামকৃষ্ণদেবের নামেই প্রধান, কদাপি সারদাদেবীর নামে। সে আপনার যে দেবতাতেই অভিরুচি হোক। কারণ রামকৃষ্ণই সব – প্রধান। কি ভাবে একটা উদারতার ছদ্মবেশে গোঁড়ামি বাসা করছে দেখুন। ধর্মের ক্ষেত্রে এটাই চিরটাকাল হয়ে এসেছে, old wine in new bottle. তাই এবারের ‘দেশ’-এও যখন সুমন সেনগুপ্ত তার লেখার শেষ লাইন লিখছেন – “শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যেই এর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ। শ্রীরামকৃষ্ণেই তাই মানবমুক্তি”, আমার কষ্ট হয় রামকৃষ্ণদেবের জন্যেই। এতটাই কি বোকা আমরা? কিসের ছদ্মবেশে কি বিষ গেলানো হচ্ছে বুঝি না? কবীর, শিরডির সাঁই, লালন – এরা কি শিক্ষা দিলেন তবে এই ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে?
এতেই যত ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেল। রামকৃষ্ণ ক্যালেণ্ডারে এলেন, প্লাস্টার অফ প্যারিসে এলেন, সিনেমায় এলেন - কিন্তু জন-চেতনার গভীরে এলেন না। কারণ তাঁকে নিয়েই যে দল আজ। মঠ আজ। আরেকটা কথা বলে প্রসঙ্গের ইতি টানি – জীবসেবা যতই রামকৃষ্ণের শিক্ষা বলে চালানো হোক, আদতে তা নয়। পুরো কথামৃতই তার সাক্ষী। তিনি প্রাচীন ভারতের প্রধান ধারায় যে ভক্তি-জ্ঞানমার্গের কথা, তার পথচারী। নারদীয় ভক্তি, অদ্বৈতজ্ঞান ইত্যাদির পরিচায়ক, সমন্বয়কারী তো বটেই। একজন ভক্ত যখন সব অর্থ দিয়ে হাস্পাতাল বানাবার কথা বলেন, রামকৃষ্ণদেব তাকে বিরত করেন। বলেন, ওসবের জন্য মানুষের জীবন না, তুমি ভক্তিলাভের সাধনা করো। এর অর্থ এই নয় যে উনি সেবার বিরোধী ছিলেন, কিন্তু তাকেই জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য করার পক্ষপাতী ছিলেন কি? ‘জীবেসেবার মাধ্যমেই আত্মার মুক্তি’ এটা পাশ্চাত্যের ধর্মের মূল সুর, যা তার প্রধান শিষ্যদ্বারা প্রচারিত। একসময় মঠে এই নিয়ে মেলা সমস্যাও হয় গুরুভাইদের মধ্যে। সারদাদেবী একটা মধ্যস্থতা করেন।
তাই মনে হয়, আদতে রামকৃষ্ণদেব বলতে যা বুঝি তা দক্ষিণেশ্বরের ঘরে গেলে কিঞ্চিৎ আভাস মেলে। তার নামে যে মিশন সে একটা পাঁচ-মিশালী সুকৌশলী প্রতিষ্ঠান। মোড়কটা অত্যন্ত উদার, ভিতরে তাই কি? সেইখানেই হল বিভ্রান্তির চূড়ান্ত। সত্যের যে জোর, কৌশলের সে জোর কি আছে?
‘Fact’-এর ব্যাখ্যা বদলে দিলে মাঝে মাঝে তা ‘আলোকে যে লোপ করে খায়, সেই কুয়াশা সর্বনেশে’ হয়ে ওঠে। আমার মনে হয় রামকৃষ্ণদেবের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কোথায় যেন একটা গোঁজামিল।