সৌরভ ভট্টাচার্য
1 January 2018
ছেলেটা কাদা মেখে পাড়ে উঠল। হাতে কয়েকটা শালুক ফুল। বাজারে যাবে। পরনের গামছাটা খুলে পাড়েই নিংড়ে নিল। লোকজন কেউ নেই। তার লজ্জাও কম। বয়েস বারো। বাবার সাইকেল সরানোর দোকান। মা ঠিকে ঝি। সে এক ছেলে।
সাইকেল নেই। হেঁটে বাজারের রাস্তা ধরল। শীতকাল। হাঁটছে তো হাটছেই। বাজারের রাস্তাটা কি দূর হয়ে গেল? এতক্ষণে তো বাজার চলে আসার কথা। ফুলদুটোর গায়ে লাগা জল শুকিয়ে গেছে। রোদের তাপ বাড়ছে। ছেলেটা গায়ের হাফ সোয়েটারটা খুলে নিল। তার সোয়েটার কোথা থেকে এলো? পাড়েই রাখা ছিল তো। একটা হাফ প্যান্ট, একটা ফুলহাতা জামা, আরেকটা হাফ সোয়েটার। সব কটাই মা যে বাড়ি কাজ করে তার ছোটো ছেলেটার।
আচমকা রাস্তাটা মেঘে ঢেকে গেল। ছেলেটা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। চারদিক ঘন কুয়াশা কুয়াশা সাদা মেঘ। দেখতে দেখতে কুয়াশাগুলো ঘরবাড়ি, বাজার তৈরি করে ফেলল নিজেদের মধ্যে। কুয়াশাগুলোই দোকান সাজিয়ে বসল, আবার কুয়াশাগুলোই কিনতে এলো। কুয়াশাগুলোই জিনিসপত্র হল। আলুপটল, হাঁড়িকড়াই, চাদর, জামা, শাড়ি সব।
ছেলেটা থ হয়ে গেছে এসব দেখে। এমন সময় একজন বুড়ো লোক, যদিও সে কুয়াশা, এসে বলল, তোমার হাতে কি খোকন?
ছেলেটা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে বলল, ফুল। শালুক।
বুড়োটা ফুলগুলো নিতে হাত বাড়ালো। ছেলেটাও দিয়ে দিল। যেই না বুড়োটার হাতে হাত লাগল তার হাত গেল ভিজে। কুয়াশার জলে।
বুড়োটা ফুল নিয়ে বেজায় খুশী। কয়েক টুকরো কুয়াশা তার বুকের থেকে বুদবুদের মত উড়ে গেল। তাতে সূর্যের আলো লেগে তৈরি হল রামধনু। ছেলেটা অবাক হয়ে চেয়ে রইল।
দাম কত? বুড়োটা জিজ্ঞাসা করতে ছেলেটা আবার চমকে চাইল, বলল, দশটাকা।
বুড়োটা তাড়াতাড়ি ফুলটা ছেলেটার হাতে দিয়ে দিল। বলল, নাও। তার বুকের ভিতর থেকে রঙ্গীন বুদবুদ বেরোনো থেমে গেল। ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তে লাগল মাটিতে।
ছেলেটা বলল, বেশ, আট টাকা দিন।
বুড়োটা বলল, নেই। আসলে আমার নাতির খুব অসুখ, তার জন্য নিতাম। কিন্তু আমার কাছে শুধু দুই নয়া আছে কেবল।
ছেলেটা বুঝল না। বলল, কই তোমার নাতি?
বুড়োটা কি ভাবল, তারপর বলল, এসো আমার সাথে, বলে বুড়োটা তার কাঁধে হাত রাখল। কাঁধ গেল ভিজে।
বেশ কিছু কুয়াশা ঘেরা রাস্তা পেরিয়ে তারা একটা কুয়াশা বাড়িতে ঢুকল। তার ছাদ, দেওয়াল, খাট, মেঝে সব কুয়াশা।
সেই খাটে একটা বাচ্চা ছেলে শুয়ে, ঘুমিয়ে মনে হল। বুড়োটা তার মাথার কাছে গিয়ে বসল। তার মাথায় হাত রাখল। বলল, এই দেখো, কে এসেছে তোমায় দেখতে!
বাচ্চাটা পাশ ফিরল। ফিরেই সে ফুলের দিকে তাকালো। বলল, আমার জন্য? সাথে সাথেই তারও বুকের ভিতর থেকে রঙিন বুদবুদ বেরোতে শুরু করল। বুদবুদগুলো জানলা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। বুড়োটা তার দিকে তাকালো। ছেলেটা তার হাতের ফুল বাড়িয়ে সেই অসুস্থ বাচ্চাটাকে বলল, সবটাই তোমার জন্য তো।
বাচ্চাটা উঠতে চেষ্টা করল, পারল না। ততক্ষণে বুড়োটার বুকের ভিতর থেকে শতশত বুদবদে ঘরটা ছেয়ে ফেলেছে। সব যেন ছেলেটার দিকে এগিয়ে আসছে।
বাচ্চাটা বুকের উপর ফুলগুলো নিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। বুড়োটা তার গায়ে একটা কুয়াশার লেপ জড়িয়ে ছেলেটাকে বলল, চলো।
ওর কি হয়েছে? ছেলেটা জিজ্ঞাসা করল। বুড়োটা বলল, কি এক অসুখ। চিকিৎসক বুঝতে পারছে না।
তুমি আমাদের সদর হাসপাতালে যাবে ওকে নিয়ে? মা যে বাড়ী কাজ করে, সেই জেঠুটা ওই হাসপাতালের ডাক্তার। আমি বলে দেব। পয়সা লাগবে না। এই দ্যাখো ওনার ছেলেরই জামা প্যান্ট সোয়েটার আমি পরে।
বুড়োটা বলল, সে হয় না। তোমাদের শরীর আর আমাদের শরীর আলাদা যে।
চলতে চলতে হঠাৎ বুড়োটা কোথায় মিলিয়ে গেল। তার চারদিকে সব কুয়াশাই মিলিয়ে যেতে লাগল। চড়া রোদ। সে বাজারের মধ্যে দাঁড়িয়ে। একটা বুড়ো সামনে। সে জিজ্ঞাসা করছে, তোমার ফুলের দাম কত?
ছেলেটা চমকে তাকিয়ে তার মুখের দিকে তাকালো। তারপর জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাতি কি অসুস্থ?
বুড়োটা বিস্মিত হয়ে বলল, তুমি চেনো আমার নাতিকে?
ছেলেটা কি বলবে ভেবে পেলো না কিছুক্ষণ। তারপর বলল, হ্যাঁ চিনি তো। ওকে আপনি এই ফুলগুলো দিয়ে বলবেন, অঞ্জন দিয়েছে।
বুড়োটার চোখের কোণা চিকচিক করছে। তাতে সূর্যের আলোর রামধনু।
ছেলেটা বলল, কাল এই সময়ে এখানে আসবেন। আমি ওকে নিয়ে হাসপাতালে যাব। আমার মা যে বাড়ি...
বলতে বলতেই ছেলেটা লক্ষ্য করল, যে ফুলগুলো শুকিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো কেমন ভিজে ভিজে। আর সেই ভেজা গায়ের উপর সূর্যের আলোর রামধনু।