ছাগলের দাম পাঁচ হাজার। বিক্রি হবে। হাটবার আজকে নয়। আগামীকাল। রম্যা কোনোবার ছাগল বিক্রীর আগেরদিন ঘুমায় না। অম্বল হয়। চোঁয়া ঢেকুর ওঠে। জোয়ান রাখা থাকে একটা পানের মশলার গোল, রঙচটা কৌটোয়। কৌটোটায় রম্যার শাশুড়ি সুপুরি রাখত। রম্যা ঢাকনা খুলে দেখল জোয়ান শেষ।
রম্যা বাচ্চাগুলোর ঘরে গেল। যমজ দুটো ছেলে, বারোবছর বয়েস। ঘুমোচ্ছে। বড় ছেলেটার মুখ থেকে লাল গড়ায় ঘুমালেই। রম্যা আঁচল দিয়ে মুছল। দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর দরজাটা খুলে উঠোনে এলো। আকাশ ভর্তি তারা, যেন দীপাবলি হচ্ছে, মেয়েরা উঠোনে, ঘরের চৌকাঠে প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছে। রম্যা চৌকাঠে বসল। গরমকাল, বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। ছাগলটা ঘুমাচ্ছে? রম্যা অন্ধকারে বুঝতে পারছে না। ছাগলটার কাছে যেতেই ছাগলটা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। রম্যা হাঁটুগেড়ে বসল, ছাগলের মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ ঈশ্বরের নাম জপ করল। মুক্তি পেয়ে যাবে কাল। একটা দীর্ঘশ্বাস কোথা থেকে উড়ে এসে যেন তার বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল।
গতবার ঠিক দাম পায়নি ছাগলের। এ গ্রামে অনেকেরই ছাগলের ব্যবসা। তাদের ছাগল নেয় মুরুগান, কাটপাডিতে মাংসের দোকান চালায়। বেশ বড় দোকান। কিন্তু গতবার কার্তিকেয় জোর করে সাড়ে তিন হাজারে অতবড় ছাগলটা নিয়ে গেল। মুরুগান পুরোনো লোক তাই কিছু বলেনি, মুরুগান ওর বউকে নিয়ে সে সময়ে তিরূপতিতে গিয়েছিল। রম্যার হঠাৎ করে টাকারও দরকার পড়েছিল, নভেম্বরের আগে ঘর না ছাইলে বৃষ্টিতে ভেসে যেত সব।
এ সব জনার্দনই দেখত আগে। জনার্দন পিল্লাই, তার দেড় বছরের স্বামী। ব্যাঙ্গালোর থেকে দুবাই গেল, রান্নার কাজে। দু'বছর টাকা পাঠালো নিয়ম করে। রম্যা দুটো ঘর পাকা করল। কিন্তু ছাদটা পাকা করার আগেই জনার্দন টাকা পাঠানো বন্ধ করল। কেউ বলল, বিয়ে করেছে। কেউ বলল, করেনি। সঠিক খবরটা কি রম্যা জানে না। রম্যা পরপর আট মাস ফোন করেছিল। জনার্দন ফোন ধরেনি। রম্যা জানত ধরবে না। জনার্দন বলত এ গ্রামে মরার জন্য সে জন্মায়নি। রম্যা কিছু বলত না। তাকে ফোন করতে দিত মীনাক্ষী আম্মা। অবশ্য ফোনের টাকা নেয়নি মীনাক্ষী আম্মা, সেই পরে ছাগলের ব্যবসা ধরিয়েছে তাকে। রম্যা ছাগলকে পাঁঠা, পাঁঠাকে ছাগল বলে, মীনাক্ষী তাকে পেত্নী বলে ডাকে। মীনাক্ষী খারাপ মেয়েদের নিয়ে কাজ করে। তার ঘরে খারাপ লোকেরা আসে। তাদের অনেকের নাকি অনেক ক্ষমতা, অনেক পয়সা। মুরুগানও আসে। রম্যা মুরুগানকে ওখানেই দেখেছিল প্রথমবার, আসলে মুরুগানই ছিল তার প্রথম আর শেষ খদ্দের।
রম্যা ছাগলটাকে ক'টা কাঁঠালপাতা দিয়ে উঠানে বসে বসেই ভোর করল। একটু পর মুরুগান আসবে। ভোর হতে না হতেই ঝোড়ো হাওয়া দিতে শুরু করল। রম্যা ভয় পেল। কালো মেঘ সাবানের ফেনার মত সারা আকাশ মাড়িয়ে আসছে। তার ঘরের দিকেই আসছে। মুরুগানকে আসতে দেবে না নাকি হতচ্ছাড়াগুলো আজ! কিন্তু টাকাটা যে আজকেই চাই তার, ঘরে চাল বাড়ন্ত। ঝড়ের হাওয়ার দাপট বাড়ল। ছাগলটা ভয়ে হোক, কিম্বা সকালে তার গলার দড়ি না খুলে দেওয়ার জন্য হোক, তুমুল চীৎকার করতে শুরু করেছে। রম্যা ঘরে গিয়ে চায়ের জল চাপাল। তার স্থির বিশ্বাস মুরুগান আসবে। গেল মাসে তার শরীর খারাপটা হয়নি, মুরুগান ভয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। আজ এইমাত্র তার শুরু হল। তার মনে হচ্ছিল আজ কালের মধ্যেই হবে। একটা আওয়াজ হল বাইরে। রম্যা বুঝল না মেঘ ডাকল, না মুরুগানের বাইকের আওয়াজ। তার বুকের ভেতর হাপর পিটাতে লাগল। তবু সে না উঠে ফুটন্ত চায়ের জলের দিকে তাকিয়েই বসে রইল। এইটুকুর জন্যেই তো বাঁচা।
হঠাৎ তার পিঠে হাত, তার বড় ছেলে, বলল, মা কার্তিকেয় কাকা এসেছে। রম্যা খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। চায়ের জলটা টান মেরে নর্দমায় ফেলে বাইরে এসে দাঁড়ালো, হাসিমুখে হাতজোড় করে বলল, কার্তিকেয় ভাই, কি মনে করে?
কার্তিকেয় বলল, এই এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম পাঁঠাটা যদি বেচো...
বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। কার্তিকেয় ভিজছে। রম্যা ভিজছে, সর্বস্ব নিংড়ে ভিজছে যেন সে। কার্টিকেয় নতুন বাইক কিনেছে। ভিজছে। চাতকের মত ভিজছে, রম্যার মনে হল।
রম্যা হাসিমুখে বলল, ভেতরে এসো।
সৌরভ ভট্টাচার্য
29 December 2018