Skip to main content

মোবাইলটা অফ্ করে চার্জে বসিয়ে, এসিটা অফ্ করে ঝুল বারান্দায় এসে বসল মল্লিকা। আঁচলে মুখটা মুছে বলল, উফ্...। 

    রাত এগারোটা। সারাদিন বৃষ্টি। কেটেছে খানিক আগে। গোটা আকাশ যেন মুছে গেছে কেউ ন্যাতা দিয়ে, যত্ন করে। সবক'টা তারা বসার ঘরের শৌখিন সাজানো জিনিসের মত জ্বলজ্বল করছে। 

    তারা দেখলেই এই তিয়াত্তর বছর বয়সটা একটা বাইরের ঘটনা মনে হয়। সমস্ত ছেলেবেলা যেন বুক আঁকড়ে বসে আছে। লুকিয়ে। তারারা ওদের বাসা জানে। ঠিক বার করে আনে। স্কুলের ব্যাগ, ভাত মেখে খাওয়ানোর সময় মায়ের চুড়ির আওয়াজ, বাড়ির সামনের পুকুর, রাস্তা... সব মনে পড়ে যায়। 
    
    ছেলে বাইরে থাকে। ফোন করে। আবার করেও না। আগে কষ্ট হত। এখন হয় না। মানুষের কাছে মানুষ হাত পাতে। ক্রমে হাতটা গুটিয়ে নিতে শেখে। আবার ভুলে যায়, আবার হাত পাতে। হাতের চেটোর এক কোণে পড়ে থাকে দান। অতি সামান্য। লজ্জা দেয়। হাত ফিরে আসে। মল্লিকার হাত পাতার বয়েস নেই আর। বরং হাত জড়ো করে সব স্বীকার করে নিলেই শান্তি। নাড়ি ছিঁড়ে দশমাস পর বেরিয়েছে বলেই কি সব অধিকার তার? 

    প্লেন যাচ্ছে। আলোর দবদবানি দেখতে ভালোই লাগে। ওঠা হয়নি। হার্টের অসুখ। ছেলের কাছে চাইলেও যেতে, উপায় নেই। এই ভালো যদিও। অবাঞ্ছিত হয়ে বাঁচা বড় দায়। দেখে শিখেছে। 

    কি করবে এখন? ঘুম তো দুটোর আগে আসবে না। তবে? 

    মল্লিকা জীবনের মানে বোঝার চেষ্টা করল আবার। প্রথম থেকে। দুঃখ ছাড়া কিছু তেমন করে সত্য নয় কেন? মানুষ দুঃখকে কি বেশি গুরুত্ব দেয়? মল্লিকা রবীন্দ্রনাথের গানের কথা মনে করল--- "তুমি কোন্ ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে…."

    ভাঙছে তো। ভেঙেছে তো। বিশ্বাস। মনে হয়েছিল সব গেল। স্বামী বিয়ে ভাঙল। ছেলে বাইরে গেল। সবারই নিজের অনেক কিছু করার। নিজেদের জন্য। মল্লিকারই যেন কিছু কাজ ছিল না। সে শুধুই তাদের সিদ্ধান্তে রাজী হবে। এই রাজী হওয়াটাই তার কাজ। কর্তব্য। তাও আবার হাসিমুখে নাকি। 

    একদিন নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছিল মল্লিকা, এত বড় জীবনে কি আয়ত্ত করেছে? কি অ্যাচিভমেন্ট তার? 

    সগর্বে উত্তর দিয়েছে, যখন মনে হয় মোবাইলটা অফ্ করে দেওয়ার সাহস। শান্তি। স্থিরতা। নিজের সঙ্গে নিজে বাস করার সততা। এই তার অ্যাচিভমেন্ট। 

    মল্লিকা গান গাইছে। রবীন্দ্রনাথের গান। নিস্তব্ধ চারদিক--- "আমি রাখব গেঁথে তারে, রক্তমণির হারে"....

    রক্তমণি। পেয়েছে। নিজেকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে, নিজের হাতে তুলে দিয়ে। সবটুকু দিয়ে যে নিজেরটা গড়া সেখানে অপূর্ণতা আছে, কিন্তু সংকোচ নেই। কুণ্ঠা নেই। ভিক্ষার অনিশ্চয়তা নেই। তাই শান্তি আছে। 
    
    "আমার ভাঙল যা তা ধন্য হল চরণপাতে…"