Skip to main content


রাস্তাটা ক্রমশ ছোটো হতে শুরু করেছে। সামনের দিকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না প্রায়। তবু হাতড়াতে হাতড়াতে মানুষটা এগোচ্ছে। আচমকাই রাস্তাটার মাঝখান থেকে দুটো টুকরো হয়ে গিয়ে লোকটা তলিয়ে গেল।

        এই স্বপ্নটা প্রায় মাসখানেক হল রাঘব দেখছে। ছোটো একটা চৌকিতে শোয়। দু’তিন বার চমকে উঠে পড়েও গেছে ঘুমের মধ্যেই। কারণটা তার যতদূর মনে হয়, এই স্বপ্নটাই। আজ সকাল থেকেই কাজে যাওয়ার ইচ্ছা করছে না। ফোনটা দেখল, হরিশদা'র তিনটে মিসড কল। আজ বালির লরি আসার কথা আছে অবশ্য। রাঘব চার বছর হল হরিশের আড়তে কাজ করছে। বালি খালাস করার কাজ লরি থেকে। কয়েকবার লরির সাথেও গেছে বালি আনতে। সে খুব বাজে অভিজ্ঞতা রাঘবের। বিষমদ খেয়ে প্রায় মরেই যাচ্ছিল। হাস্পাতালে পনেরোদিন মত ছিল। বমির সাথে রক্ত, পায়খানা... অবশ্য মরলেও ক্ষতি ছিল না, সাতকূলে কে আছে তার? এই বৈশাখে সে তিরিশে পা দেবে।
        রাঘব আবার শুয়ে পড়ল। এই একচিলতে ঘরটাতে তারা তিনজন থাকে। ভুবন আর গোবিন্দ কাঠের কাজ করে কলকাতার কোথাও একটা। নৈহাটিতে এসেই তার সাথে আলাপ। তার নিজের বাড়ি সন্দেশখালি। ওরা দু'জন কাজে বেরিয়েছে। রাঘব শুয়ে শুয়ে ফোন ঘাঁটতে লাগল। কালই নেট কার্ড মেরেছে, তিনদিনের। ফোনটা গেলবার পূজোয় কিনেছে, স্মার্টফোন, আজকাল এই ফোন না থাকলেই নয়। ফেসবুক, ওয়াটস অ্যাপ সব হরিশদাই শিখিয়েছে। হরিশ তার থেকে বছর ছয়েকের বড়।
        অনেক মেয়ের সাথে ওয়াটস অ্যাপে কথা হয়। তার মধ্যে কিছু খারাপ পাড়ার, রাঘব জানেও। মাঝেই মাঝেই সুইটি আর চম্পা তাকে বিরক্ত করে। নিজেদের ভুলভাল ছবি পাঠায়। চম্পাকে তার ঘেন্না করে। তবু চম্পার সাথেই তার কয়েক রাত কাটানো হয়ে গেছে। কেন সে তার নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়। যেন তার মধ্যে আরেকটা রাঘব আছে, খারাপ রাখব।
        রাঘব উঠে পড়ল। টয়লেট ঘুরে এসে বসল। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। সাড়ে ন’টা বাজে। বাজারে কচুরি ফুরিয়ে যাবে এরপর গেলে, শীতের বেলা তাই এখনও পাবে হয়ত। দরজায় তালা দিয়ে বাইরে এলো। গায়ে একটা উইন্ডচিটার, আর পায়ে পায়জামা। উইন্ডচিটারটা আষাঢ় মাসে কেনা। দীঘা যাওয়ার পথে এস্প্ল্যানেড থেকে। চম্পা পছন্দ করেছিল।
        রাঘব জানত বাজে রাস্তায় সবাইকেই জোর করে লোকে নিয়ে আসে। চম্পা বলেছিল, না, আমায় কেউ জোর করে আনেনি। মাকে ছেড়ে বাবা চলে গেল তখন আমি পেটে। জন্মের পর থেকেই দেখছি শালা মাকে দশবাড়ি বাসন মেজে খেতে হয়। তার উপর সময় মত বাড়িভাড়া দিতে না পারলে বাড়িওয়ালার শরীরের গরম মেটাতে হয়। আরো ছিল। পাড়ার কিছু দাদা টাইপের লোক। আমায় একদিন নষ্ট করল ওদেরই একজন। আমার তখন চোদ্দো বছর বয়েস। মাকে বলেছিলাম। মা কিছু না বলে ব্যাগ থেকে একটা ওষুধ বার করে খাইয়ে দিয়ে বলল, কাউকে বলবি না। এরপর আরো কয়েকবার হল। একই কেত্তন। তখন ভাবলাম, শালা এও তো পেশা একটা। তা লুকিয়ে চুরিয়ে কেন, একদম খুল্লামখুল্লাই করলে হয়। টাকাও আছে, মস্তিও আছে। লাইন ধরে নিলাম। কন্ডোম ছাড়া কাস্টমারের থেকে বেশি মাল খেঁচা যায়। যদিও সব ভদ্দর সমাজের ডাক্তারেরা এসে ফি বছর আমাদের জ্ঞান দিয়ে যায়, ফ্রি'তে বেলুন দিয়ে যায়। আরে শালা তোরা কাস্টমারদের বোঝাবি? কতরকম পাব্লিক সে আর ওরা বুঝবে কি করে? তা এ লাইনে যখন এসেছি মরতে তো হবেই কুত্তার মত। তবু কম বয়সে চলে যাওয়াই ভালো রে। বয়েস হলে বুড়ি বেশ্যামাগীগুলোর যা অবস্থা হয়! ধুঁকতে ধুঁকতে মরে। অনেকের তো খাওয়ার সম্বলও থাকে না। আমাদের মধ্যে কারোর দয়া হল তো দিল কিছু, নইলে মর মাগী...
        এক রাত ছিল দীঘায় চম্পার সাথে। যেত না। গল্পটা ছিল ফিল্মি কিছুটা। প্রিয়াঙ্কাকে ভালোবাসত। এই নৈহাটিতেই আলাপ। ধোকা দিল মালটা। তার আরো কতজনের সাথে চক্কোর চলছিল সে নিজেও জানে কিনা সন্দেহ। আসলে গ্রামের ছেলে ছিল, বোকাসোকা। দেব-জিৎ- শাহরুখ এইসবই ঘুরত মাথায়। হরিশদাই চম্পার সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। হরিশদার এদিকে বউ আছে। তবু। প্রথম প্রথম কারণ জিজ্ঞাসা করতে লজ্জা পেত। তারপর যখন হরিশদার বেশ বিশ্বস্ত লোক হয়ে গেল, তখন একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল। হরিশদা হেসে বলেছিল, ও ছোটা রিচার্জ। বুঝবি না, বিয়ে কর বুঝবি।
        রাঘব আজও বোঝেনি, তবে মাঝেমধ্যেই যে হরিশদার ছোটা রিচার্জের দরকার হয় সেটা জানে। রাঘব গুপীর দোকানে কচুরী আর চা খাচ্ছে। মাথাটা জ্যাম হয়ে আছে। কাল হরিশদার জন্মদিন ছিল। পার্টি হয়েছে। গলা অবধি টেনে মেসে এসেছিল। এসেও কি একটা ক্যাঁচাল হয়েছিল। সে হবেই। যে রাতেই সে মাল টেনে আসে সেই রাতেই তুমুল অশান্তি হয় তার আরো দু'জন মেসের সঙ্গীর সাথে। তারা বৈষ্ণব। গলায় কণ্ঠী। দেখলেই গা-পিত্তি জ্বলে যায় রাঘবের। ভণ্ডামি যত। এদিকে রাতদিন মালিককে ফাঁকি দেওয়ায় ধান্দা আঁটছে, ওদিকে বোষ্টুম সেজে বসে আছে।
        কাল রাতের ঘটনাটা মনে পড়তেই মেজাজটা খিঁচিয়ে গেল আবার রাঘবের। চম্পা বলছিল, ও নাকি একটা ঘরের খোঁজ দিতে পারবে। তারই মত মালখোর থাকে ওই ঘরেই একটা। কি একটা লোহালক্কড়ের কাজ করে। চম্পা এর বেশি জানে না। সেও চম্পার কাস্টমার।
        কচুরী শেষ। চায়ে চুমুক দিচ্ছে রাঘব। রাস্তাঘাট বেশ ভিড়ভিড়। একটু পর শুনলো ট্রেন অবরোধ নাকি। রাঘব উঠে স্টেশানের দিকে গেল। থিকথিক করছে লোক। পকেটমারিটা শিখতে পারলে হত। কতরকম কাজ আছে সত্যিই পয়সা রোজগারের। ক'টাই বা সে জানে। নৈহাটির এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে এগোতে লাগল। ওদিকেই জমায়েতটা বেশি। কি সব বলে যেন চীৎকার করছে। রাঘব একটা সিগারেট ধরালো। যদিও এখানে এসব খাওয়া বারণ। তবে আজ পুলিশের ওসব সময় নেই দেখার।
        হঠাৎ কি একটা গোলমাল বেধে গেল। সবাই হুড়মুড় করে ছোটাছুটি শুরু করল। আচমকা ওই ভিড়ের মধ্যে দেখে চম্পা একটা লোকের হাত ধরে ছুটছে। রাঘব নিজে কিছু বোঝার আগেই দেখল সে ছুটতে শুরু করেছে চম্পার পিছন পিছন। লোকটা কে? নতুন কাস্টমার? তাহলে সে দিনের বেলা তাকে নিয়ে এই হরতালের মধ্যে কি করছে? ভাবতে ভাবতে সে দৌড়াতে লাগল। হঠাৎ কি হল বোঝার আগেই তার চোখে অন্ধকার নেমে এলো।
        বিকালে জ্ঞান এলো যখন দেখে সে নিজের মেসের ঘরে। ভুবন তাকে নিয়ে এসেছে। মাথায় পুলিশের লাঠির বাড়ি পড়েছিল। ভুবন বলল, তোমার জ্ঞান এর আগেও কয়েকবার ফিরেছিল... চম্পা কে? তোমার তো কেউ নেই শুনেছি সাতকূলে...
রাঘব উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। মাথাটা টনটন করছে। দাঁড়াতে গিয়ে টাল খেল। নিজেকে সামলে নিয়ে ভুবন কিছু বোঝার আগেই বাইরে এলো। একটা রিকশায় উঠে পড়ল।
চম্পার ঘরের দরজায় তালা। রাঘব সুইটির ঘরে এলো। সে সাজছিল। তাকে দেখেই ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল, কি পথ ভুল করে? বলেই সে তার মাথার ব্যাণ্ডেজটা দেখেই আঁতকে উঠে বলল, কার সাথে মারামারি করে এলে?
        রাঘবের কি যেন একটা হয়ে গেল... সে সুইটিকে জড়িয়ে বলল, চম্পা কোথায় বলো না প্লিজ... কেউ বলছে না... ও কি কাজ ছেড়ে দিল?...
        সুইটি বলল, ছাড়ো বলছি। সুইটি দরজাটা লাগিয়ে এলো। খাটে বসল, রাঘবকে বলল, বোসো। চম্পা পালিয়ে গেছে। রতনদার সাথে। রতনদার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ডাক্তার বলেছে, আর বড়জোর দেড় বছর... ওরা এখন স্বামী-স্ত্রী হয়ে সংসার করবে। নৈহাটি কালী মন্দিরে কাল রাতে বিয়ে করেছে। মাসি অনেক করে বুঝিয়েছিল, এ রাস্তায় একবার এলে আর ফেরা যায় না... কে শোনে কার কথা... আরে বেশ্যা হোক আর যাই হোক... মেয়েমানুষ তো...
        সুইটির চোখে জল... কান্না দেখতে পারে না রাঘব... সে দুটো একশো টাকার নোট সুইটির পাশে রেখে বাইরে বেরিয়ে এলো... রাস্তায় একা একাই হাঁটছে... উইন্ডচিটারের চেনের দু'পাশে রক্তের দাগ লেগে। তার রক্তের দাগ লেগে। তার নিজের শরীরের। তার রক্তের ধারার কি হবে? সে কি তাতেই শেষ হয়ে যাবে? তার ছেলেমেয়ে হবে না? তারা তার রক্তের অধিকারী হবে না?... রাঘবের মাথাটা টনটন করতে লাগল ব্যাথায় আরো। একটা রিকশা ডাকলো... বলল, কালীবাড়ি চলো...