Skip to main content
 
 
 
---
পয়মালের জামা। রজনী নিজের শুকনো কাপড়টা তুলতে তুলতে খেয়াল করল। পয়মাল ইচ্ছা করে তার শাড়ির পাশে মেলে গেছে। রজনী আড়চোখে একবার নিত্যকে দেখে নিলো। নিত্য খেয়াল করেনি। সে ধান সিদ্ধ করতে মশগুল।
        রজনীর গায়ের রঙ কালো। বিয়ের সময় একেবারে ছিপছিপে গড়ন ছিল। লোকে বলত কেউটে। তার চোখে, চলনে নাকি বিষ। অবশ্য বিষ ছিল বলেই বাপটা মরার পর গ্রামে টিকতে পেরেছিল। নইলে ছিঁড়ে খেত তাকে শকুনের দল। বিয়ে হল এই নয়াবপুরে। তাদের গ্রাম থেকে মেলা দূর। দেখতে দেখতে বছর দশ হল। এখন রজনী ছিপছিপে নয়। কিছুটা স্থূলই বলা চলে। কিন্তু তার চলায় নাকি এখনও সাপের ছন্দ, লোকে বলে। সে বিশ্বাস করত না। বিশ্বাস করল পয়মালকে দেখে। তার বুকের মধ্যে সেই হিসহিস শব্দ। চোখের কোণায় সেই অহর্নিশি জ্বালাপোড়া। গরম নিঃশ্বাস।
পয়মাল এই গ্রামে এসেছে মাস চারেক হল। ওর দিদির বাড়ি এখানে। জামাইবাবুর হাতে হাতে সাহায্য করবে। সর্ষে বুনেছে। বলাই ধানসিদ্ধ করে, ও গিয়ে গিয়ে মাটিতে সিদ্ধধান মেলে, জলে ডোবায়, দীঘি থেকে জল আনে। বিজুলি আর ঘর থেকেই বেরোয় না। বলে আমিও যদি মাঠে যাব তো পয়মাল এলো কি কত্তে?
        পয়মাল, বিষধর সাপ একটা। সাপ না, সাপুড়ে। রজনী নিজের মনে মনে হাসে। রজনীর রান্নাঘরটা ক্ষেতের ধারেই একদম। পয়মাল ধান ঝাড়ে, জল আনে - রজনী দেখে।
        পয়মালের আবলুস কাঠের মত কালো শরীরে পেশির ঢেউগুলো বর্ষার কালো জলে দীঘির ঢেউয়ের মত তার বুকে আছড়ে পড়ে। রজনীর ভাত পোড়ে, ডালে নুন কম হয়, ভিজে কাপড় পুকুরের ধারে পড়ে থাকে।
        রজনী বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝেছিল নিত্য সাপও নয়, সাপুড়েও নয়। খরগোশ একটা। ঘুম আর খাওয়া, তার শরীরের চাহিদা বলতে এইটুকু। আর তার সতীন ওই চাষের ক্ষেত। নিত্য ধানের শীষে হাত বোলায় যেন যুবতী নারীর শরীর। দুপুরে মাঠেই ঘুমায়, বলে মাটির গন্ধে তার ঘুম হয় নাকি রাজার পালঙ্কের মত। রাতে তার পাশে শুতে হয় তাই শোয়। যেন মন্দিরের পাথরের দেবতা। সেই দেবতাও তাই রেখেছে তাকে বাঁজা করে। তাতেও তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। শোক নেই। বলে এক পরিবারের সন্তান না হলে তো জগৎ আর জনশূন্য হয়ে যাচ্ছে না, অত চিন্তা করে কি লাভ?
        রজনীকে জাগালো পয়মাল আবার। রজনী যেন ঘুমিয়েছিল কত যুগ ধরে। ভুলেই গিয়েছিল নিজেকে।
        এই তো ক'দিন আগের কথা। রজনী দুপুরে খেয়ে উঠে শীত করছে বলে বাইরের রোদে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ বিজুলি ডাকল লুডো খেলতে। রজনী দেখল পয়মাল তার দিদির পাশে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। গিলে খাওয়া দৃষ্টি। একবার ভাবল, না বলে দিই, কি দরকার আগুনে হাত পুড়িয়ে? তবু গেল। কেন গেল স্পষ্ট নয় তার কাছে, তবু গেল। সে তো এরকম হাঁটে না আজকাল। তার কি হল? এত অবাধ্য কেন তার শরীর আজ? গিয়ে বসল। সাপলুডো খেলা হবে। রজনীর বুকের ভিতরটা ধকধক করছে। কানের ভিতর থেকে যেন গরম হাওয়া বেরোচ্ছে। তার হাত কি কাঁপছে? হাতের তলা এত ঠান্ডা কেন সাপের মত? তার কি জ্বর আসছে? একটা দান দিয়ে ঘুঁটি সরাতে গিয়ে পয়মালের হাতে হাত ঠেকল। পয়মালকে বলল, "উফ্... কি শক্ত গো তোমার হাত! যেন নোড়ায় হাত দিলাম!
        পয়মাল হেসে গড়িয়ে পড়ল। রজনীও হাসল, কিন্তু মুখে। বিজুলি টের পেল। পয়মালকে বলাই ডাকল। সে উঠে গেল। বিজুলি তার কাছে এগিয়ে বলল, “আমার ভাইটা কিন্তু জাত খেলোয়াড়, ওর ফাঁদে পা দিসনি, সব ছারখার হয়ে যাবে, বুঝলি?”
রজনী জানে না, কি বুঝবে আর কি বুঝবে না। উচিত, অনুচিত ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত সে এখন। রজনী একটা খোলা মাঠ চায়। একটা কালবৈশাখী চায়।
 
 
---
ঝামেলাটা হওয়ারই ছিল। অসন্তোষ তলে তলে একটা দানা বাঁধছিলো বেশ কিছুদিন ধরে বলাই আর পয়মালের মধ্যে। পয়মাল কাজে ফাঁকি দিচ্ছে, এই ছিল মূল অভিযোগ।
        সেদিন যথারীতি পয়মাল দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে। ততক্ষণে বলাইয়ের এক প্রস্থ ক্ষেতের কাজ সারা। মাঠে জলটল দিয়ে দাওয়ায় এসে বসেছে বলাই। বিজুলি চারটে রুটি আর গুড় দিয়ে স্নানে গেছে। বলাই খাচ্ছে, ইতিমধ্যে পয়মাল হাই তুলতে তুলতে দাওয়ার একটা কোণে এসে বসল। বলাইয়ের মাথাটা গরমই ছিল। পয়মালকে নিয়ে আজ শহরে যাবে ঠিক করেছিল, কিন্তু বাবুর যা ভাবগতিক তাতে মনে হচ্ছিল না যাবে। তাই-ই হল। পয়মাল বলে দিল আজ সে যেতে পারবে না, শরীরটা ভালো নেই। বলাই ফেটে পড়ল। পয়মালেরও মেজাজ গেল চড়ে। রাগের মাথায় বলাই বসার পিঁড়িটা তুলে পয়মালের মাথায় মারল। পয়মাল প্রথমটা ঘাবড়ে গেল অত রক্ত দেখে। পরক্ষণেই গায়ের জামাটা খুলে মাথায় জড়িয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো। চীৎকার করে বলতে বলতে গেল, সে বলাইকে থানায় দেবে, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ছাড়বে ইত্যাদি, ইত্যাদি।
নিত্য তখন ক্ষেতে ছিল। হঠাৎ দেখে পয়মাল টলতে টলতে এগিয়ে খানিক দূর গিয়ে পড়ে গেল মাটিতে। নিত্য দৌড়ে গিয়ে দেখে মাথা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পয়মাল আর বলাইয়ের মনোমালিন্যর ব্যাপারটা নিত্য জানত। সে তাড়াতাড়ি পয়মালকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে ছুটল।
        রজনী সদ্য স্নান করে ভিজে কাপড় নিংড়িয়ে উঠোনে শুকোতে দিতে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিত্যকে পয়মালকে নিয়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকতে দেখে সে দৌড়ে গেল। নিত্য হাঁপাচ্ছে। সে বলল, "তুমি একটু কাঁচা হলুদ নিয়ে ওর মাথায় চেপে ধরো, আমি এক্ষুণি গিয়ে মিত্তির ডাক্তারকে ডেকে আনি।" রজনী 'হ্যাঁ' বা 'না' কিছুই বলল না, শুধু হাঁ করে পয়মালের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর যন্ত্রচালিতের মত হলুদ বাটতে বসল। চোখ অকারণ ঝাপসা হতে শুরু করেছে। আচমকা বিজুলির আর্তনাদে তার সম্বিৎ ফিরল। বিজুলি উঠোনে ঢুকে রক্তের ফোঁটা দেখে দেখে পয়মালের ঘরে ঢুকে পড়ে চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। গ্রামে ইতিমধ্যে খবরটা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছে। রজনীর বাড়ির উঠোন উপচে পড়ছে ভিড়ে। কেউ বলছে হাস্পাতালে নাও, কেউ বলছে পুলিশে খবর দিতে হবে, কেউ বলছে পুলিশে খবর দিলে বলাইয়ের আর না হোক বারো বছরের জেল। এই কথা শুনে বিজুলির কান্নার দমক আরো বেড়ে গেল।
        খগেন মিত্তির আসলে ডাক্তার না। এক সময়ে শহরের খুব নামকরা ডাক্তার চঞ্চল ঘোষের কম্পাউন্ডার ছিল। এখন বয়েস হয়ে যাওয়াতে আর শহরে যেতে পারে না, এখানেই এই জ্বর-সর্দি-কাশি এই সবের চিকিৎসা করে মোটামুটি চলে যায়। মিত্তির কম্পাউন্ডার যখন এল তখন পয়মালের জ্ঞান এসে গেছে। কিন্তু এত লোক, এত চীৎকার চেঁচামেচিতে ঘাবড়ে গিয়ে চুপ করে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে বিজুলির দিকে আড়চোখে দেখছে। বিজুলি ভয় পাচ্ছে, পাছে ভাই পুলিশ কাছারিতে বলাইকে জড়ায়। যা মাথা গরম ওর। পয়মাল এদিকে ফিরলেই বিজুলি চোখ মুছছে আর বলছে, “যা লিখেছেন ভাগ্যে ভগবান তাই তো হবে, কি বলেন দিদি?” পাশে বসা গ্রামের এক বুড়ি মাথা নেড়ে নেড়ে সায় দিয়ে যাচ্ছে।
        রজনী পাথরের মত বাড়ির এক কোণায় দরজায় হেলান দিয়ে আঁচলে মুখের অর্ধেকটা ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ জ্বালা জ্বালা করছে, বুকের ভিতরটা কেমন হাপর পেটাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন এখনই জ্ঞান হারাবে। শক্ত করে দরজার পাল্লাটা আঁকড়ে ধরে আছে। ঘর ভরতি লোক। নিত্য পয়মালের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে মিত্তির ডাক্তারের সাথে কথা বলছে। পাশে জানলা। জানলা দিয়ে উঠোনের গাছে জবাফুল গাছটা দেখা যাচ্ছে। পাশে কিছু গাঁদা। থরে থরে গাঁদা হয়েছে এ বছর। রজনীর মন হঠাৎ ঘরের এই কোলাহল ছাপিয়ে বাইরে চলে গেল। সে যেন একা কুয়াশায় হাঁটছে। তার আগে আগে একটা পুরুষ। পুরো দেখা যাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে। পয়মাল চলেছে আগে আগে।
 
 
 
---
ঠিক হল পয়মাল কয়েকদিন এখানে থাকবে। বলাইকে দেখলেই উত্তেজনা বাড়বে, কি হতে কি হবে, তার চাইতে এখানেই থাক। নিত্য বলল, “আমার কোনো আপত্তি নেই। ও যেমন বলাইয়ের বউয়ের ভাই, তেমনই ওরও তো ভাই, কি বলো?” বলে নিত্য একবার রজনীর দিকে তাকালো। রজনী মাথা নেড়ে হাসার চেষ্টা করল। বিজুলি আড়চোখে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিল।
        ধীরে ধীরে ঘর ফাঁকা হল। নিত্য গেছে ওষুধ আনতে বিপ্রর সাথে। বিপ্র নিত্যর কাকার ছেলে। রজনী বাইরে দাওয়ায় এসে বসল। তারা সারাটা শরীর মন অবশ হয়ে আছে কিসে যেন। হঠাৎ-ই একরাশ ক্লান্তি যেন তাকে ঘিরে ধরল।
        বেলা গড়িয়েছে ভালোই। সামনের আমগাছের ছাওয়াটা ছোটো হয়ে প্রায় গাছটার গোড়ার কাছে এসে ঠেকেছে। গ্রামে অন্যদিন হলে এতক্ষণে অনেকেরই খাওয়া দাওয়া হয়ে গিয়ে রোদে বসে পড়া হয়ে যেত। লুডোখেলা, উকুন বাছা, শুকনো ধান মাড়ায় তোলা, গল্প-হাসি-ঠাট্টা তো আছেই। এই গ্রামে তার কত বছর হয়ে গেল। সামনের শ্রাবণে সে আটাশে পড়বে। নিত্য তার চেয়ে পনেরো বছর বড়। 
- জল...
        পয়মাল জল চাইছে। কিছুক্ষণের জন্য যেন সে পয়মালকে ভুলে গিয়েছিল। মনটার স্থিরতাটা পলকেই কেটে গেল। সারা শরীর দিয়ে একটা শিহরণ নামল যেন। উঠে গিয়ে জল গড়ালো, ধীরে ধীরে পয়মালের ঘরে ঢুকলো। পয়মাল হাসার চেষ্টা করল। বলল, “মাথার মধ্যে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে জানো, একটু বরফ হলে ভালো হত না? কিন্তু বরফ কোথায় পাবে বলো?”
        পয়মাল উঠতে চেষ্টা করল। পারল না। রজনী মাথার কাছে বসে তার মাথাটা তুলে ধীরে ধীরে তার মুখে জল দিতে লাগল। দুঢোক গিলেই সে বলল, “থাক, আর দিও না। কি বিপদে ফেললাম বলো তোমাদের? আমি সুস্থ বোধ করলেই ফিরে যাব আমার গ্রামে, কে মরতে থাকে এখানে, মেরেই ফেলবে শালা আমায় কোন দিন!
        রজনী কিছু বলল না। উঠে আবার বাইরে চলে এলো। ভেজা কাপড়গুলো মাটিতে দলা পাকিয়ে পড়েছিল, মেলাই হয়নি। একটা একটা করে কাপড় মেলতে মেলতে রাস্তার দিকে তাকাতে থাকল, এত দেরি হচ্ছে কেন ওদের ফিরতে? বিপ্রর মোটর সাইকেলেই তো গেছে। ও... আজ তো বৃহস্পতিবার, কাছের দোকানটা তো বন্ধ। শহরে যেতে হবে। কিচ্ছু খায়নি লোকটা সকাল থেকে। রজনীর হঠাৎ খুব রাগ হল। সবটাতেই যেন বাড়াবাড়ি লোকটার, কেন গ্রামে আর বাড়ি ছিল না? আজ যদি এসে পুলিশে তাদের ধরে? আর তার নিজের ভাই নেই? কেন খামোখা সে পরের ভাইকে ভাই-ই বা পাতাতে যাবে, আশ্চর্য!
        রজনী হনহন করে বিজুলির বাড়ির দিকে এগোলো। বিজুলিকে রাস্তাতেই পেয়ে গেল, গরু ছাড়তে গিয়েছিল মাঠে। ভোর থেকে যা হল। ঘটনাটার সময় তো সে ঘরেও ছিল না, নাইতে গিয়েছিল বড় দীঘিতে। আজ বৃহস্পতিবার, পাঁচালী পড়া আছে, বাড়িতে লক্ষ্মীর ঘট আছে। 
- তুই এসে তোর ভাইয়ের কাছে বোস দিকিনি, আমার কি কোনো ঘরের কাজ নেই যে তোর ভাইকে আগলে বসে থাকতে হবে? আর অমন অসুস্থ মানুষটাকে তুমি আমার ঘাড়ের উপর ফেলে দিয়ে আরামে থাকবে, তাও হবে না বলে দিলুম কিন্তু।
        কথাগুলোতে ঝাঁঝ ছিল যথেষ্ট। কিন্তু বিজুলি বুঝল। মনে মনে হেসে বলল, “পোড়ারমুখী। যাও গিয়ে আমি আসছি।
        ফেরার পথ ধরতেই রজনী যেন চলার শক্তি হারিয়ে ফেলল। আবার তার কান গরম হতে শুরু করেছে, মাথাটা দপদপ করছে। কয়েক পা এগোতেই মোটর সাইকেলের আওয়াজ শুনে পিছনে ফিরে তাকালো। নিত্য আর বিপ্র আসছে। রজনী থমকে দাঁড়ালো। কেন যেন তার হঠাৎ নিজেকে অপরাধী লাগছে। ভগবানে তার বিশ্বাস নেই। ও তার কাছে পুতুলখেলা। বড়দের পুতুলখেলা। তবু সে আজ সেই পুতুলকে স্মরণ করেই বলল, "রক্ষা করো ঠাকুর!"
 
 
---
রক্ত ধরে গেছে। ব্যাথায় মাঝে মাঝে ককিয়ে উঠছে পয়মাল। ওষুধ পড়েছে। পয়মালের রাগও খানিক নরম হয়েছে। যদিও বলাই একবারও আসেনি দেখতে। পয়মাল সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের ওষুধ দিয়েছে।
        রজনী শুতে এসে দেখে নিত্য এখনও ঘুমায়নি। মোবাইলে বাউল গান শুনছে। নিত্য গান ভালোবাসে। শুতে যাওয়ার আগে রোজ গান চালায়, একটা গান হতে না হতেই ঘুমিয়ে পড়ে। রজনী এসে বন্ধ করে। আজও রান্নাঘর থেকে গানের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল রজনী, ভেবেছিল ঘুমিয়েই পড়েছে।
- তোমার কি খুব অসুবিধা হবে ওকে আনলাম বলে? 
- আমার অসুবিধা হবে না। কিন্তু অমন জোয়ান মরদ ঘরে থাকলে গ্রামের লোকে যদি দুচারটে কথা বলে...।
- ধুর, লোকের কথা ছাড়ো তো... আজ আমি যদি না দেখতাম ছেলেটা হয়ত মাঠেই মরে পড়ে থাকত। কোথায় ছিল সব লোক? ভগবানের কাছে মুখ দেখাতাম কি করে?
রজনীর কোথায় যেন একটা বিঁধল। সে শান্ত হয়ে বলল, “আচ্ছা, শুয়ে পড়ো, সকাল থেকে যা ধকল গেল।
 
        পয়মাল সুস্থ হয়ে নিজের গ্রামে ফিরে গেলো দুদিন পরেই। বিজুলি টানা এসে রজনীদের বাড়ি ছিল এই দু'দিন। বলাই তার বোনের বাড়ি রাণাঘাটে গেল। লোকে বলল, পুলিশের ভয়ে। বিজুলি বলল, তার বোনের নাকি ডেঙ্গু।
        বিজুলির রজনীর সাথে থাকার দুটো কারণ ছিল। এক, তার ভায়ের মন গলানো, যাতে সে পুলিশে খবর না দেয়; দুই, ভায়ের চরিত্র সে জানে, তাই রজনী আর তাকে চোখে চোখে রাখা।
        পয়মাল ফিরে যাবে রজনী জানত। তবে এত তাড়াতাড়ি যাবে সে ভাবতে পারেনি। পয়মাল চলে যাওয়ার পর সে শরীর খারাপের আছিলায় তিনদিন বিছানায় পড়ে রইল। লোকে বলল, হবে না, যা পরিশ্রম দুই সইতে করল। লোকে নিজের ভাইয়ের জন্যও এত করে কিনা সন্দেহ। নিন্দুকে বলল, নিত্য'র চুলে পাক ধরেছে কি না, তাই পর-পুরুষে অত সোহাগ! নিত্য কান দিল না, রজনী শোনার মত অবস্থায় ছিল না। 
        তবু তিনদিন পার হওয়ার পর রজনীর মনে একটা হাল্কা ভালো লাগা এলো। সে সকালে উঠে যখন উনুনে আঁচ দিতে বসল, নিত্যের মনের কালো মেঘ কেটে গেল। নয়ত সে আজই ভেবেছিল খগেন ডাক্তারকে খবর দেবে। রজনী ধীরে ধীরে পুরোনো ছন্দে ফিরতে চেষ্টা করল। মানুষ মনের শূন্যতার সাথে বোঝাপড়ার জন্য চিরকালই একটা স্থূল কাজের অবলম্বন খোঁজে। রজনীর যে কাজ আগে একঘেয়ে বিরক্তিকর লাগত, আজ তাই তাকে গভীর শান্তি দিল। সে দু'রকম মাছ রাঁধল। তোষক, চাদর রোদে দিল। বড়ি দেওয়ার জন্য ডাল বাটলো। নিত্য মুখে বলল, "এত শ্রম কোরো না, কাহিল হয়ে পড়বে, এই তো শরীর খারাপ থেকে উঠলে।" মনে মনে যদিও সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। গ্রামে যারা অকথা-কুকথা বলে তাদের মুখে একটা যোগ্য জবাব হল। রজনী শুধু কথা বলছে আগের থেকে কম। সে যা হোক, ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।
রজনীর বুকটা পয়মাল যে চৌকিতে শুয়েছিল সেটা দেখলেই টাটিয়ে ওঠে। সে নিত্যকে বলল, "এ চৌকিটায় উঁই ধরেছে জানো, তুমি এটা ঘাটে ফেলে একটা নতুন চৌকির ব্যবস্থা করো দিকিনি।"
        নিত্য তন্নতন্ন করে উঁই খুঁজল। কিচ্ছু পেল না। ভাবলে হয়ত তার চোখের জোর কমেছে। সে চৌকি বিদায় হল। রজনীও অনেকটা স্বাভাবিক এখন। যেন সে ফাঁড়া মুক্ত হল। অজান্তে ফাঁদে পা পড়লে তার থেকে মানুষ স্বীয় চেষ্টায় মুক্তি পেলেও পেতে পারে, কিন্তু জেনেবুঝে ফাঁদে পা দিলে ফাঁদের যন্ত্রণা আর ফাঁদ থেকে মুক্তির ইচ্ছা কোনোদিকেই সে পুরোপুরি এগোতে পারে না।
        সেই ফাঁদ আরো শক্ত হল, যখন কদিন পর থেকে পয়মালের ফোন আসা শুরু হল রজনীর মোবাইলে। প্রথম প্রথম কথা হত সৌজন্যমূলক। ক্রমশ কথার ধারা গ্রাম্য ঠাট্টা থেকে নিষিদ্ধ মহলে ঢুকে পড়ল। রজনীর লজ্জা লাগত। ভালোও লাগত। পাপ মনে হত। আবার নিজেকে বড্ড জীবন্তও মনে হত। একটা নেশার মত লেগে গেল। আগে তার চার-পাঁচ মাসে একশো টাকা ভরালে হয়ে যেত, এখন একমাসও যায় না।
প্রথম সন্দেহ করল বিপ্র। নিত্যের খুড়তুতো ভাই। একদিন সে ঠাট্টা করে বলেই ফেলল, “কি বৌদি, এত ঘনঘন টাকা ভরাচ্ছো? প্রেমটেম করছ নাকি? দেখো বাবা, বুড়ো বয়সে দাদাটাকে আমার ভাসিয়ে যেয়ো না।
        বিপ্রর মোবাইল রিচার্জের দোকান। সেই দোকানে আরো দু'জন দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের সামনেই কথাটা বলল বিপ্র। যেন ইচ্ছা করেই বলল। রজনীর কান-মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল দোকানে দাঁড়িয়ে। এটা-সেটা বলে কোনোমতে পালিয়ে এসে বেঁচেছিল।
নেশা তার কাটল না। ক্রমে তার ভয় সংকোচ কেটে যেতে লাগল। একবার নিত্যকে লুকিয়ে স্টেশানে দেখাও করে এলো পয়মালের সাথে। পয়মাল বাইকে এসেছিল। তাকে কাছেই নিয়ে যাবে বলে গাড়িতে চাপিয়ে দূরে নিয়ে গেল। তারপর একটা ফাঁকা নির্জন জায়গা দেখে... ছি ছি!
        তবু রজনী যেতে চায়। তার সাহস এখন আগুনের মত সর্বনাশা। যখন তখন ফোন আসে পয়মালের এখন। নিত্যর সামনে ফোন এলেও ধরে। নিত্যকে বলে তার বাপের বাড়ির গ্রামের এক বন্ধু। নিত্য মাথা ঘামায় না। কিন্তু কোথাও একটা কাঁটাও বেঁধে। ফোন এলে রজনীর মুখের ভাব বদলায় কেন? সে তো অন্ধ নয়! খচখচ করতে থাকে সে কাঁটা। সে কাঁটা ঝোপে সার দিল বলাই। একদিন মাঠে তাকে বলল, "ঘর সামলা নিত্য... বউ মানুষের অত ফোনে কথা কিসের?"
        কথাটায় ঠেক খেলো সে। তাই তো! ইদানীং রজনী যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে, সেও খেয়াল করেছে। প্রায়ই ওর ফোনটা চার্জে বসানো থাকে। আগে তো ফোন বন্ধ হয়ে পড়ে থাকত দিনের পর দিন। নিত্য কোনো দরকারে পেতই না প্রায় ওকে। তারপর একে ওকে ফোন করে বাড়িতে খবর পাঠাতো। 
        একদিন দুপুরে সে যে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল তাই হল। কি একটা রেঁধে রজনী বিজুলিদের বাড়িতে গেল দিতে, ফোন চার্জে বসিয়ে। নিত্য তাড়াতাড়ি ফোনটা চার্জার থেকে খুলে শেষ নাম্বারটা ডায়াল করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো চেনা গলা... বুড়োটা ঘুমিয়েছে সোনা...
        নিত্য ফোন কেটে দিল। তার সারা গা থরথর করে কাঁপছে। মাথাটা দিয়ে আগুনের ফুলকি ছুটছে। কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে সোজা ক্ষেতে চলে এলো। ধানের শীষ, মাটির গন্ধ, প্রজাপতি, ধানের পোকা - সব বিরক্তিকর, অসহ্য মনে হতে লাগল। চিৎ হয়ে মাঠে শুয়ে পড়ল। আকাশ দেখতে বরাবরই খুব ভালো লাগে নিত্যর। এই সংসারের এত কাছে থেকেও যেন কত দূরে। ঠিক ভগবানের মত। নিত্যর মনে কোনো বিরুদ্ধভাব স্থায়ী হয় না বেশিক্ষণ। সে যত বড় শত্রুই তার হোক না কেন। আর এত রজনী, তার অগ্নিসাক্ষী করা বউ। নিত্যর মনের মধ্যে একটা বৈরাগ্যের আচ্ছন্নতা তৈরি হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন সে চাইলে এখনই এই সংসার ছেড়ে বাউল হয়ে বেরিয়ে পড়তে পারে। সংসার ছাড়ার ভাবনাটা মাথায় আসতেই তার মনটা বৃষ্টির জলের মত শান্ত হয়ে গেল। সে চলে যাবে। কে রজনী? দিনেরই বা পরিচয়? কেই বা পয়মাল?
 
 
---
রজনী জানতে পারল ফিরে আসার খানিক পরেই। মোবাইলটার আওয়াজটা বন্ধ করা ছিল। পয়মালের বারোটা কল। ফোন করতেই রজনী বুঝল কি হয়েছে। সারাদিন সে নিজের সাথে প্রচুর লড়াই করল। মনে মনে যেন সে এই দিনটার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলই। তাই যতটা ভয় পাবে সে আশঙ্কা করেছিল ততটা হল না বটে, কিন্তু যতটা সহজ হবে ভেবেছিল ততটাও হল না। পাপবোধটা মানুষ জন্ম দেয় না। পাপবোধটার মধ্যে সে জন্মায়। তাই যত সহজে তাকে অস্বীকার করে, বাস্তবে দেখে তা সম্ভব না। তার শিকড় অনেক গভীরে। যত জোর করে তাকে উপড়াবার তত গভীরে ঢুকে নিজেকে ক্ষত বিক্ষত করে মানুষ। রজনীও করল।
        প্রথমেই মনে হল ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। দিল না। ক্রমে মনটা যত শান্ত হতে শুরু করল, তার মনে হল সমাজের চোখে সে অপরাধী হলেও নিজের কাছে সে অপরাধী নয়, কিছুতেই নয়। কি পেয়েছে সে সারাটা জীবন নিত্যর কাছে? একটা কাজের লোকের মত সংসার করে আসছে এতগুলো বছর। তার নিজের কি সাধ আহ্লাদ বলে কিছুই থাকতে নেই? সে কিছুতেই ক্ষমা চাইবে না। কিন্তু পয়মাল কি তাকে বিয়ে করবে? এটা তো সে এতগুলো মাসেও বুঝে উঠতে পারল না। যতক্ষণ পয়মালের সাথে কথা বলে ততক্ষণ এ চিন্তা তার মাথাতেও আসে না, এ কথা সে কথায় পয়মাল তাকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়... পারেও ছেলেটা, কিন্তু...
        তবু নিত্য যখন ঘরে ঢুকল তার সমস্ত যুক্তি, সাহস, ইচ্ছা কোথায় ঝুরঝুর করে খসে পড়ে গেল। সে মানুষটার মুখের দিকে তাকাতেই পারছে না। আড়ষ্ঠ হয়ে বসে রইল। কিভাবে কি কথা শুরু করবে বুঝেই উঠতে পারছে না।
        নিত্য খাটের আরেক কোণায় বসল। সেই কথা শুরু করল। 
- তুমি নিজেকে দোষী ভেবো না জানো, আমি সত্যিই তোমায় সংসারে নিয়ে এসে কি দিতে পেরেছি বলো... কোনো সুখই দিতে পারিনি... কি করব বলো, আমি মানুষটাই এরকম। তোমার দুর্ভাগ্য যে...
        রজনী ঘাবড়ে গেল। সে এটা আশা করেনি। মনে মনে সে নিত্যকে নপুংসক, মেরুদন্ডহীন বলতে চেষ্টা করল। পারল না। মন বলতে চাইলেও হৃদয় বলতে চাইল না। রজনী নিজের মধ্যে দু'ভাগ হয়ে যেতে লাগলো। ওদিকে নিত্য তার নিজের অক্ষমতা প্রকাশের শেষ সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে। নিত্য কাঁদছে। রজনী আর সহ্য করতে পারল না, উঠে দাঁড়িয়ে নিত্যকে কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় বিজুলির গলার আওয়াজে চমকে উঠল। নিত্যও চমকে উঠেছে। ওদিকে বিজুলি চীৎকার করতে করতে ঢুকছে, "আরে রজনী আছিস... ঘুমালি নাকি... শোন আমার ভায়ের কাণ্ড শোন...", বলতে বলতে ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়ালো। রজনী আর নিত্যকে দেখে কিছু একটা বুঝেও যেন বুঝতে চাইল না। 
        রজনীর কাঁধে হাত রেখে বলল, “কি বলব তোকে পয়মালের কাণ্ড, ব্যাটা ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে বুঝিনি...”, তারপর নিত্যের দিকে ফিরে বলল, “আরে আপনার ভাইয়ের সেই খুড়তুতো বোন আছে না, সুজাতা, ওকে নাকি বাবুর খুব পছন্দ। আজই মাকে বলেছে। ওদের নাকি ফোনে ফোনে কথাও হয়। তা মা ফোন করে আমায় বলল, তুই কি জানিস কিছু? আমি আর কি জানব বলুন? আমার তো ক্ষেত আর গরু নিয়েই সারাটা দিন চলে যায়। তারপর আমি লাগালুম ফোন সে ছোঁড়াকে। আমায় কি বলে জানেন? তোর ঘরেই এমন পাত্রী থাকতে বাইরে খুঁজতে যাব কেন...
 
        বিজুলি আরো কি বলল, কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল সে কথা রজনী জানে না। 
পরের দিন গ্রামের লোক দেখল নিত্যর বাড়ির দরজায় তালা দেওয়া। বিপ্র বলল, “দাদা বৌদি শ্রীক্ষেত্রে গেছে।
 
 
(ছবিঃ সুমন)