আমি রোজ ভাবছি পলাশ নিয়ে আর গল্প নয়। কিন্তু রঙটাই এমন। দুটো বাচ্চা, গায়ে কিচ্ছুটা নেই। হোটেলের সামনে একটা ভাঙা শিব ঠাকুরের মূর্তি নিয়ে পুজো পুজো খেলছে। শিব ঠাকুরের মাথার অর্ধেক নেই, হাত একটা, একটা পায়ের গোড়া নেই। দুজন উলঙ্গ বাচ্চা তাঁর পায়ে পলাশ দিচ্ছে। তার মধ্যে একজন আবার উলুধ্বনি দেওয়ার চেষ্টা করছে।
রাস্তায় এত লোক কারোর চোখে পড়ছে না। আমি দৃশ্যটা দেখতে দেখতে ভাবলাম সেই পুরাণের গল্পের কথা, মদনকে মহাদেব ভস্ম করে দিলেন। কেন? না মহাদেবের ধ্যান না ভাঙলে তো চলছিলই না দেবতাদের। এদিকে মহাদেবের ধ্যান কে ভাঙাবে? শেষমেশ রিস্ক নিলেন মদনদেব। চারদিকে বসন্তের আয়োজন করলেন। মহাদেবের হৃদয়ে আঘাত হানলেন পঞ্চবাণের। ব্যস, মহাদেবের ধ্যান গেল ভেঙে, বেজায় চটে গেলেন, দিলেন শাপ, ভস্ম হলেন মদন।
কিন্তু কামদেব ওরফে মদনদেব ভস্ম হলে বিশ্বসংসার চলবে কি করে? বলি বৈরাগ্য দিয়ে তো আর সংসার চলে না। এই যেমন আমার বেলুড়মঠে আরতি শুরু হলেই ভাবনা লাগে, আচ্ছা এই যে সন্ন্যাসীরা বসে বসে চোখ বন্ধ করে গাইছেন "খণ্ডন ভব বন্ধন", এর না হয় একটা মানে বুঝি, কিন্তু এই সে অফিস কাছারি করে এসে বাবুরা বসেছেন, ওই যে হেঁশেল সামলে এসে মা জননীরা বসেছেন, এনারা সব্বাই মিলে কি এই ভব বন্ধন খণ্ডন করতে চাইছেন? তবেই তো হয়েছে। ঠাকুরের সামনে মিছে কথা কইতে আমার লজ্জা লাগে। তাই আমি বেছে বেছে কটা লাইন গাই, এই যেমন সম্পদ তব শ্রীপদ ইত্যাদি। সে অন্যকথা, কোথাকার কথা কোথায় আনলাম।
তো মদনদেব ভস্মের পর তাঁর স্ত্রী এসে কেঁদে পড়লেন, ওগো এ তুমি কি করলে গো… আমার স্বামীটাকে এরা বার খাইয়ে পাঠিয়েছিল… সে বোকাসোকা মানুষ… তুমি একটু কনসিডার করলে না…. ওগো তুমি তো আশুতোষ….
আপনারা ভাবছেন মদনদেব বোকা কেন হবেন? এ প্রশ্ন যদি মনে এসে থাকে তবে নিতান্তই বেরসিক আপনি। প্রেমে পড়লে মানুষ যেমন বোকা হয়, অমন বোকা চিটফাণ্ডে টাকা রেখেও হয় না। কি বোকামিই না করতে হয়। সব কম্পোজড ব্যক্তিত্বের সাড়ে ছত্রিশ ভাজা অবস্থা…ভালো আছি না খারাপ আছি বোধগম্যি নেই… নিজের শরীরে মনে আরেক শরীর মনের আনাগোনা… তার উপর সে যদি ট্যাঁড়া পাব্লিক হয় তো নাকানিচোবানি খাওয়া.. হাপিত্যেশ করা… হাতে-পায়ে ধরা.. উফ্, পুরো ব্যক্তিত্বের কাবাড়া লেগে যাওয়া আর কি!
তো মহাদেব ঠাণ্ডা হয়ে বললেন, বেশ তোমার স্বামী আর তুমি মানুষের চিত্তে বিরাজ করো গিয়ে… তোমার স্বামীর নাম হবে অনঙ্গ। মানে আর কি, নো অঙ্গ।
আমি যেতে যেতে ভাবছি মহাদেবের কথা, শেষে কিনা তাঁর পায়েই পড়ল এসে পলাশ! আমার এক এক সময় মনে হয় বসন্তের পরেই হাড়জ্বালানি গ্রীষ্মের আবির্ভাবকেই কবি হয় তো মদনভস্মের রূপে দেখেছেন। বসন্তের এই আরামদায়ক আবহাওয়াকে পুড়িয়ে ছারখার করেই তো গভীর বৈরাগ্য নিয়ে গ্রীষ্মের আবির্ভাব।
ফেরার পথে দেখলাম মহাদেব অর্ধেক ঢাকা পড়েছেন পলাশে। পূজারী দুজন নেই। নিশ্চয়ই তারা এতক্ষণে অন্য খেলায় মেতেছে, আর নইলে মায়ের বকুনি খেয়ে লক্ষ্মী ছেলেমেয়ের মত বই নিয়ে বসেছে। মহাদেব পলাশের ভার নিয়ে একা কি করবেন? হয় তো পার্বতীকে ডাকবেন। হয় তো বলবেন, এসো হে, ছেলেমেয়ে দুটো যে রঙ লাগিয়ে গেল তুমিই বা বাদ যাবে কেন?
তাই হয় তো বসন্ত আর গ্রীষ্মের মধ্যে এসে দাঁড়ালো দোল। রঙের উৎসব। বাকি সব উৎসব ভক্তি, ভাবগাম্ভীর্যের, কিন্তু এই একটি উৎসব যেখানে কৃষ্ণ একা এলেই রসভঙ্গ, এখানে রঙের মাধুর্যকে আহ্বান করতে লাগে রাইকিশোরীকে। রাই না বলে বৈরাগ্যের মানই বা কোথায় আর জ্ঞানানলের শিখার চূড়াবিন্দুই বা কোথায়? সবই তো রাইয়ের। হৃদয়ের শূন্যতা জ্ঞানে ভরে না, ভরে প্রেমে। যে প্রেম আগুনের মত সর্বগ্রাসী, সর্বত্যাগী। যার শুরুতেও মাধুর্য, মধ্যেও মাধুর্য, অন্তিমেও মাধুর্য। সে মাধুর্যই তো রাধিকা। একদিকে মদন আর একদিকে মহাদেবকে রেখে যিনি যাকে উতলা করেন, তিনি তাই মদনমোহন। মদনকে যিনি ভস্ম করেন না, মোহিত করেন। গোটা জগতে এই তো সব দর্শনের সার। কেউ মহাদেবে এসে ঠেকে, কেউ মদনভস্মে। যে রাইকিশোরীর নূপুরের তানে ডোবে, সে-ই হালে পানি পায়। আনন্দে। সে-ই বলে, সবটা মিলিয়ে তো হেব্বি মজা গো... কেন বাপু সাত পাঁচ ভেবে ভেবে শুকিয়ে মরছ.... কান পাতো.... নিজেকে ছাপিয়ে বাইরে এসো.... আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে.... রাইকিশোরীর আরেক ভক্ত এ গান শুনিয়ে আমাদের মাতিয়ে গেল না এই সেদিন? সব কি মিছে কথা? ধুস! সত্যিও নয়, মিছেও নয়, সব আনন্দের কথা.... পথের কথা... অভিসারের কথা....