Skip to main content
 
 
 
      ভিজে কাপড় শুকায় নাকি এই জোলো বাতাসে? তবু ভিজে কাপড়টা গায়ে জড়িয়েই বসে থাকা। হু-হু করে বইছে জোলো বাতাস। বাতাসে এত জল আসে কোত্থেকে কে জানে? আকাশের মেঝেতে যেন কাদা লেপেছে এমন মেঘের রঙ। ঠাণ্ডা বাতাস। শীত শীত করছে। খিদে পেলে ঠাণ্ডা লাগে বেশি। শীত শীত করে। গায়ে পদ্মকাঁটা ফোটে। মুড়ি আছে সঙ্গে, থাক। একটু পরে।
      পা দুটো মেলা থাক। মাথায় গাছের ছাওয়া। পায়ে বৃষ্টির জল। এতটা সময় কারোর হাতে থাকে না এখন। আমার আছে। সব ঋতুই অতিথি। ডাকতে হয়। আদর করে ডাকতে হয়। যে যেমন সাড়া দেয়, যে যেমন আপ্যায়ন ভালোবাসে।
      বাটায় পান আছে। কাল রাতে সাজা। একটা মুখে দিলেই আমেজ। চোখ জুড়িয়ে যাবে। বিদ্যুৎ চমকালো। দিনের বেলা, তাই বুঝলাম না স্পষ্ট, রাত হলে উনুনে ফুঁ দেওয়া হল্কা আলো উপচে পড়ত। উফ্...! আওয়াজ কি! মেঘ পুরুষ। যেমন কণ্ঠস্বর, অমন পেশীবহুল শরীর, কি দাপট! পুরুষের মত দাপট, মাটি তো মেয়েমানুষ, তার ঘর তছনছ করে, মাথা উঁচু করে থাকা গাছগুলোকে মাটিতে এনে শোয়ায়, দাপট না? আমার কথা ছাড়ো মন, আমার ঘরে ধুলো আর ধুলো, মানুষ কই?
      পান থাক। মনের বাটা খোলা। কত পুরোনো গন্ধ। এবারের দুর্গাপুজোটাও বাইরেই কাটবে। রান্নার বায়না আছে। ব্যাঙ্গালোরে। কত পুজো ঘরে থাকা হয় না। ধুলোর ঘর, স্মৃতির ঘর। আশ্বিন আসে। আমার তাকে আর আপ্যায়ন করা হয় কই? সেই কালীপুজো কাটিয়ে ঘরে ফেরা। ততদিনে কাশফুলের রঙ ঝরে গেছে। উঠোনে কত শুকনো পাতার ডাই। ঘরের মধ্যে গুমোট গন্ধ।
      তখন আমি কাজে যেতাম না। মানুষে মানুষে গিঁট বাঁধা সংসার। আমার পুরুষ হেঁটে চলে বেড়ায় তখন। আমার সন্তান মা ডাকে। ঘরে ধুনোধূপের গন্ধ, ফুটন্ত ফ্যানের গন্ধ, চোখ জ্বালানো রান্নার ঝাঁঝ... কি যে রাঁধে তোর মা... ছেলে তখন আমার পিছনে বাটি নিয়ে, ঝোলের মাছের আগে চাই ভাজা মাছ।
      কেউ কাড়েনি। সময় কেড়ে নিয়ে গেল। সময় হরির লিখন। কত কাঁদে মানুষ? বুকের মধ্যে জোয়ারের জল দেখলাম, এখন ভাঁটার টান। দুই-ই তো নিতে হয়। যখন শান্ত হয়ে আসে তখন বুঝতে হয় সমুদ্র বেশি দূরে নেই। এই বুকের ভিতরটা রতনের বাবাকে দেখে টাটিয়ে উঠত, ক’মাস বাইরে কাজে গেলে এই বুকের ভিতর খরার মত মাটি ফাটার আওয়াজ। রতন এলো, মাটিতে অঙ্কুর হল। তখন রতনের বাবা মালী, আমি মাটি। রতন বাড়ে, আমাদেরই চোখের সামনে সে একটা জোয়ান মদ্দ হল। রতনের বাবা পার্টি করত, রতনও পার্টিতে গেল, ওর বাবাই টানল। সেই কাল হল। 
      বৃষ্টিটা বাড়ল। পা-দুটো কেমন ডুবে গেছে দেখো জলে। যেন নেই। মুড়িগুলো বিস্বাদ। মিইয়ে গেছে। এই যে সোনার বালাটা হাতে, এটাই থাকে এখন, নইলে ফাঁকা ফাঁকা লাগে, যেন অন্যের হাত। মানুষের জীবন যেন অন্যের লেখা যাত্রাপালা, দেখো। যা যা ভেবেছি তাই তাই হয়? এখন তো কি ভেবেছি ভুলে গেছি। ভালো আছি। নিজের বুকের ভেতরটাকেই যা ভয় শুধু। কোন গর্তে যে কি কান্না, কি বদখেয়াল চেপে আছে কে জানে। এই যে গাছটা, এর তলাতেই বাপ-ছেলের গলা কাটা দেহ পাওয়া গেছিল। আমি দেখিনি, জ্ঞান ছিল কই? একদিন রাতে এই গাছের ডালেই ঝুলতে এলাম। গাছে উঠতে পারি না, কোনো রকমে টেনে হিঁচড়ে উঠলাম। কি তিথি নক্ষত্র মনে ছিল না। কিছুটা উঠেছি, দেখি সামনের আকাশটা ঘষটাতে ঘষটাতে উঠল আধফালি কুমড়োর মত চাঁদ। সেই আলোতেই আমাদের গ্রামটা দেখা যাচ্ছে। আমি একটা ডালের উপর বসে, হাতে গলায় দেওয়ার গরু-বাঁধা দড়ি। মরব। কিন্তু সত্যিই কি মরতে চাই? সব গুলিয়ে গেল। মনে হল, না, মরব না, বাঁচব। মরার জন্য তো তাড়া নেই, সে তো আমি চেষ্টা না করলেও হবে। কিন্তু আমি চেষ্টা না করলে তো বাঁচতে পারব না। কি মায়া জন্মালো। সারারাত গাছেই কাটালাম। বিশ্বাস হবে না, আমার স্পষ্ট অনুভব হল রতন আর ওর বাবা গাছের নীচে বসে আমায় পাহারা দিল। আমি গলা ছেড়ে কাঁদলাম, ওই প্রথম। আওয়াজ বেরোল না। মুখটা হাঁ হয়ে থাকল খানিকক্ষণ। শুধু মনে হতে লাগল আমার বুকটাকে কেউ যেন দা দিয়ে ফালা ফালা করে দিচ্ছে। সহ্য করে থাকলাম। বুকটার পাঁজরগুলো টাটিয়ে উঠল। মনে হল দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আওয়াজ বেরোলো না। চিঁ চিঁ করে শব্দ বেরোচ্ছিল গলা থেকে।
      ভোরে নেমে এলাম গাছ থেকে। উঠোন নিকোলাম। রান্নার কাঠ জোগাড় করলাম। ভাত চড়ালাম। সেই প্রথম নিজের জন্য রাঁধলাম। নিজের একার জন্য চালের হিসাব নেওয়া যে কি কঠিন কাজ গো! তারপর পার্টির ছেলেরাই রান্নার কাজ জোগাড় করে দিল। রান্নার আমার সুখ্যাত আছে। এখন তো প্রায়ই যেতে হয়, তবে কি নিজের একার জন্যে চাল নেওয়ার চাইতে দু'শো মানুষের চালের হিসাব করা অনেক সহজ, তাই না বলি না, যাই।
      উঠি, আজ মন্দিরে রান্না আছে। কালীপুজোর খিচুড়ি বসাতে হবে। প্রতি অমাবস্যায় হয় আমাদের গ্রামে। ওবেলায় বৃষ্টি না হলেই বাঁচি, এতগুলো মানুষের খাওয়াটা মাটি হবে তবে।