সৌরভ ভট্টাচার্য
12 May 2020
বুবুন স্কুল থেকে ফেরার সময় আজ আবার রেল কলোনীর থার্ড এভিনিউটা ধরল। এই রাস্তাটা তার খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে এই দুপুরের সময়টায়। আজ ক্লাস ফিফ্থ পিরিয়ডেই শেষ হয়ে গেল। ক্লাস নাইনে পড়ে বুবুন। সাদা জামা, সবুজ প্যান্ট, পিঠে ব্যাগ, ব্যাগের সাইডে মুখ বার করে অর্ধেক ভর্তি জলের বোতল।
রাস্তাটা শুনশান। একটা সাইকেল করে বাচ্চাকে নিয়ে তার মা চলে গেল। বুবুন ভাবল, তার মা কেন সাইকেল চালাতে পারে না? শেখেনি কেন? এখন শিখলে হয় না? বুবুন এসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছে। ডানদিকে চারটে বাড়ির পর সেই বাড়িটা আসবে। বাড়ি মানে রেলের কোয়ার্টার্স। বুবুনের ‘কোয়ার্টার্স’ শব্দটা ভালো লাগে না। তার বন্ধুরা, যাদের বাবারা রেলে কাজ করে না, তারা কেমন 'বাড়ি' বলে, সে কেন মিথ্যা মিথ্যা 'কোয়ার্টার্স' বলতে যাবে? অবশ্য বাবার চাকরি শেষ হয়ে গেলে তাদের চলে যেতেই হবে। সে অনেক দেরির কথা।
বুবুন বাড়িগুলো দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগল। প্রথমটা বিশ্বাস কাকুর, পরেরটা সমাদ্দার জেঠুর, তার পরেরটা শর্মিলা আন্টির, তারপর মুখার্জিকাকুর, তারপরেরটা...
বুবুন এসে দাঁড়ালো পঞ্চম বাড়িটার সামনে। এটা একটা পরিত্যক্ত একতলা রেলের কোয়ার্টার্স। একদিন নাকি সামনে অনেক বড় বাগান ছিল। এখন জঙ্গল। একটা খুব সরু ভাঙা ইট-ওঠা রাস্তা, বহুকালের বন্ধ দরজা থেকে এই পিচের রাস্তা অবধি, সে ঘাসের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাড়িটার পিছনে এত জঙ্গল যেন বাঘ বা হাতি বেরোলেও অবাক হওয়ার নয়। রাস্তার উপরে একটা জং-ধরা ভাঙা লোহার গেট। বন্ধ নয়। একটা পাল্লা বন্ধ অবস্থায়, আরেকটা ভেঙে আধশোয়া হয়ে পাশে পড়ে আছে। বুবুন বন্ধ হয়ে থাকা দরজাটার লোহার খোপগুলোর মধ্যে পা ঢুকিয়ে দরজাটার উপর উঠল। একটু ঠেলার চেষ্টা করল, যদি ঘুরে যায়, তবে বেশ নাগরদোলার মত হবে। কিন্তু কোনোদিনই দরজাটা একচুলও নড়ে না। ক্যাঁক ক্যাঁক আওয়াজ হয় খালি। আজও নড়ল না।
বুবুন দরজা থেকে নেমে ইটের রাস্তা ধরে বাড়িটার দিকে এগোলো। সারা রাস্তা জুড়ে রাধাচূড়া ফুল পড়ে আছে। হলুদ হয়ে আছে ভাঙা রাস্তাটা। ভাঙা ইটের ফাঁকে ফাঁকে কত ফুল ঢুকে। একটু এগিয়েই দাঁড়ালো বুবুন। কত কাঠবিড়ালী রে বাবা! এত তো দেখেনি কোনোদিন! তারা ফুলগুলো একটু করে মুখে দিচ্ছে আবার দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আবার কতগুলো আসছে। বুবুন দেখেছে পশুপাখি তাকে খুব একটা ভয় পায় না। সে নিজেও পায় না। বুবুন অল্প অল্প পা টিপে টিপে বাড়িটার দিকে এগোতে লাগল, যাতে কাঠবিড়ালীগুলো ভয় না পেয়ে যায়।
বাড়িটার একেবারে সামনে চলে এলো। সামনেটা কাঠের জাল জাল মত দিয়ে ঢাকা। কাঠের জাফরি। বুবুন নিজের হাতদুটো চোখের দু-পাশে আড়াল করে বাড়িটার মধ্যে উঁকি দিল। ভিতরটা পুরো অন্ধকার। সামনে একটা বারান্দা দেখা যাচ্ছে। প্রচুর ঝুল বারান্দার ছাদটায়। বারান্দায় তিনটে দরজা তিনটে ঘরের জন্যে। বুবুন ভঞ্জজেঠুদের এরকম কোয়ার্টার্স দেখেছে। তিনটে বড় বড় হলঘর। সামনেটা বড় কমন বারান্দা। পিছনে ঠিক এরকম একটা বারান্দা, তার একদিকে রান্নাঘর, আরেকদিকে টয়লেট।
দেওয়ালে একটা টিকটিকি দেখতে পেল বুবুন। আচ্ছা কেউ কি সত্যিই এই ঘরে থাকে না? বুবুন একবার পিছন ফিরে তাকালো। রাধাচূড়া গাছটার ফাঁক দিয়ে সূর্যটা দেখা যাচ্ছে। এটা গরমকাল, অনেকক্ষণ বেলা আছে। বাড়িতেও জানে না যে আজ স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে। দেরি হলে ক্ষতি নেই আজ।
বুবুনের আজ ইচ্ছা হল বাড়িটার পিছন দিকে যাবে। আজ ফুলপ্যান্ট পরা আছে, অসুবিধা নেই, নইলে যা চোরকাঁটা ওদিকে! অন্য একদিন ওদিকে যেতে গিয়ে ফেরত চলে আসতে হয়েছিল। বুবুন পা টিপে টিপে বাড়িটার পিছন দিকে গেল। প্রচণ্ড ঝোপ। এত বড় বড় গাছ এদিকে যে অন্ধকার অন্ধকার হয়ে আছে এই ভর দুপুরবেলাতেও। বুবুন পিছনের দিকের বারান্দায় ওঠার সিঁড়িটার কাছে এল। এখানেও দরজায় তালা দেওয়া। তালাটায় মরচে পড়ে আছে। কিন্তু সিঁড়িটা এত পরিস্কার কেন? একটা ফাঁকা দেশলাই বাক্স আর একটা সিগারেটের ফাঁকা বাক্স পেল বুবুন। প্যাকেট দুটো দেখেই মনে হল খুব পুরোনো নয়। খাওয়া সিগারেটও দেখল। তার মানে কি কেউ আসে এদিকে? বুবুন একবার উপরের দিকে তাকালো। একটা ভাঙা লাইট হোল্ডার, জং ধরা লোহা। কাঠের জাফরি বেয়ে লতানো গাছ উঠে গেছে। বুবুন আবার চোখ দুটোর দু-পাশে হাত ঢেকে ভিতরে দেখার চেষ্টা করল। কিচ্ছু দেখার নেই। প্রচণ্ড অন্ধকার।
বুবুনের কতবার মনে হয়েছে এই বাড়িটার মধ্যে যদি কোনো রাজকুমারী বন্দী হয়ে থাকত। আজকাল তো রাজকুমারী হয় না, না হোক। তবু রাজার মত কোনো বাড়ির খুব সুন্দরী মেয়ে বন্দী হয়ে থাকত। এই জঙ্গলের মধ্যে অনেক ভয়ংকর জীবজন্তু থাকত। বুবুনের একটা বন্দুক থাকত, আর একটা ছুরি। সে একদিন রাতে এসে মেয়েটাকে উদ্ধার করত। লুকিয়ে নিয়ে চলে যেত। কে বা কারা তাকে বন্দী করে রেখেছে সেটা স্পষ্ট করে ভাবতে চাইত না বুবুন। তারা যেই হোক বুবুনের বুদ্ধির কাছে হেরে যেতই। সেই মেয়েটাকে দেখে বুবুন মুগ্ধ হয়ে যেত। মেয়েটাও বুবুনের সাহস দেখে তাজ্জব হয়ে যেত। মেয়েটার মাথায় কোঁকড়ানো চুল। নীল মণি চোখ। লাল টুকটুকে ঠোঁট। বুবুনের থেকে বেশি লম্বা হত না। বুবুনকে জড়িয়ে বুবুনের কালো ঠোঁটের উপর সে চুমু খেত। রাধাচূড়া গাছের ফাঁক থেকে সূর্যের আলো এসে পড়ত মেয়েটার মুখের ওপর। এরপর বুকের ভিতরে কেমন সব অনুভূতি হত বুবুন বুঝতে পারত না। একটা কষ্ট কষ্ট আনন্দ। এমন কেন হয়? যতবার মেয়েটা তাকে চুমু খেয়েছে, যতক্ষণ ধরে খেয়েছে, ততক্ষণ তার বুকের মধ্যে ওরকম কষ্ট কষ্ট আনন্দ হয়েছে। সারা শরীর দিয়ে কষ্ট আর আনন্দটা একসাথে বালির স্রোতের মত বয়ে বয়ে গেছে। বুবুন পড়ার ব্যাচের অনেক মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছে, কিন্তু তার মনে আঁকা সে মুখটার সাথে কারোরই মিল নেই। কাউকে দেখলেই ওরকম কষ্ট হয় না।
বুবুন সিঁড়ির উপর বসল। একটা পিঁপড়ের সারি শুকনো ড্রেনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, সেটা দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে কিছু একটা ভাবছিল বুবুন, হঠাৎ শোনে কারোর কথা বলার আওয়াজ, সামনের রাস্তার দিক থেকে আসছে। এদিকেই আসছে। বুবুনের কি মনে হল যেন, সে তাড়াতাড়ি দৌড়ে ঝোপের মধ্যে ঢুকে একটা বড় বটগাছের গুঁড়ির আড়ালে চলে গেল। বসে পড়ল ঝোপের মধ্যে। ঝোপটা একটু ফাঁক করে দেখল দুটো লোক এসেছে। তাদের হাতে একটা শাবলের মত কিছু। চারদিকে দেখে নিয়ে দুই ধাক্কায় তালাটা ভাঙল। ধীরে ধীরে দরজাটা খুলল। ভিতরে চলে গেল। বুবুনের বুকের ভেতরটা ধড়াস ধড়াস করছে। কি করবে ওরা? চুরি? কি চুরি করবে? এটা তো একটা পোড়োবাড়িই বলা চলে! ভিতর থেকে ঠকাস ঠকাস শব্দ হচ্ছে অল্প অল্প। বুবুনের পায়ের কাছে মশা ছেঁকে ধরছে। কি করতে আজ এইদিকটায় যে আসতে গেল! নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে।
তবে বেশিক্ষণ লাগল না। লোকদুটো চলে এল বাইরে। হুড়মুড় করে চলেও গেল। বুবুন গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ঝোপ ঠেলে খুব ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগোলো। দরজাটা খোলা। কি করবে? যাবে? কিন্তু ওরা আবার চলে আসে যদি? মনে হচ্ছে আর আসবে না। কাল আবার বন্ধ হয়ে যায় যদি? বুবুন খুব আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে বাড়িটায় ঢুকল। কি একটা উত্তেজনা হচ্ছে তার। এতদিন ধরে সে ভেবেছে ঢুকবে, কিন্তু বুঝতেই পারত না কিভাবে হবে। আজ আচমকাই এমন সুযোগ, ভাবাই যায় না!
প্রথমে বড় বারান্দাটা, তারপরে বড় একটা ঘর। কি ঝুল কি ঝুল! কি বিকট গন্ধ একটা! বুবুন নাকে রুমালটা বেঁধে নিল, নইলে হাঁচি শুরু হয়ে যাবে এক্ষুণি, তার আবার ডাস্ট এলার্জি আছে। মেঝেতে লোকগুলোর পায়ের ছাপ। চটি পরে এসেছিল ওরা। বুবুনের পায়ে সাদা কেডস। খুব সাদা নয় যদিও।
ঘরের মধ্যে কিচ্ছু নেই তেমন। সব ঘরগুলো ঘুরল। সামনের বারান্দায় এলো। ভাঙা গেটটা দেখল। সূর্যটা অনেকটা ঢলে গেছে। মানে বিকেল হয়ে গেল? মনটা একটু খারাপ খারাপ লাগছে বুবুনের। যেন তার স্বপ্নটায় কেউ ঝুল মাখিয়ে দিয়েছে। বুকটায় এখন শুধুই কষ্ট। আনন্দ নেই। যেন রাজকুমারীকে সে আসার আগেই কেউ নিয়ে চলে গেছে। তার সাথেই যে কেন এরকম হয় সবসময়? তার থেকে দেখে পরীক্ষায় লিখবে কিন্তু তার থেকে বেশি নাম্বার পাবে; তার যে বলে আউট হওয়ার কথা নয়, সে বলেই আউট হবে -- ভাল্লাগে না।
হঠাৎ বাইরে ঝোপ নড়ার আওয়াজ শুনল। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল বুবুনের। তাড়াতাড়ি বাড়ির পিছনের দিকের বারান্দার দিকে এগোলো। ওরা আবার ফিরে এসেছে, পিছন দিক থেকে! তাকে দেখতে পেয়েছে?
না, একগাদা শুয়োর। বড়, বাচ্চা মিলিয়ে অনেকগুলো। কেউ নিশ্চয় চরাতে এসেছে মেথরপট্টি থেকে। তাদের স্কুলের দিকে যেতে পড়ে মেথরপট্টি। ওরাই রেলের কলোনীতে আসে দুপুরের দিকে শুয়োর চরাতে। বুবুন বাইরে এসে দাঁড়ালো। একটা বুড়োমানুষ লাঠি হাতে শুয়োর তাড়াতে তাড়াতে তার সামনে এসে পড়ল, তাকে দেখেই বলল, ইহা কেয়া কর রহে হো...? যাও ঘর যাও... খতরনাক সাঁপ-য়াপ ভরা হুয়া হ্যায় ইহা... যাও...
বুবুনের চোখ আটকালো একটা মেয়ের দিকে। বুড়োর নাতনি? তার চাইতেও কালো, দু’দিকে দুটো লালফিতে দিয়ে বিনুনি বাঁধা, একটা কালো ফ্রক, ছেঁড়া, ময়লা... তার দিকে তাকিয়ে আছে, হাত তার একটা সরু কাঠি। বুবুনের বুকের মধ্যে আবার সেই কষ্টটা হল, আনন্দ লাগা! যেন সে বল নিয়ে দৌড়াচ্ছে, গোল একটা হলেও হতে পারে। কিন্তু এ তো রাজকুমারী নয়... কিন্তু চোখদুটো তো পুরো তার দেখা রাজকুমারীর মত... হোক না সে শুয়োর পালকের নাতনি... না হয় তারা শুয়োর মাঠে ছেড়ে গল্প করবে... কিন্তু চুমু?... তাও খাবে... স্নান করলে সব ধুলো চলে যাবে....
বুবুন মেয়েটার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে, মেয়েটাও তাকিয়ে। চারদিকে শুয়োরগুলো ঘোৎ ঘোৎ আওয়াজ করে ঝোপঝাড় তোলপাড় করছে। ঠিক যেন বুবুনের বুকটার মত। ধক ধক আওয়াজ হচ্ছে, বুবুন শুনতে পাচ্ছে। মেয়েটার মুখের উপর পড়ন্ত সূর্যের আলো। মেয়েটাকে তার দাদু আচমকাই ডাক দিল। মেয়েটা..."আয়ি" বলে দিল ছুট। যেতে একবার বুবুনের দিকে তাকিয়ে হাসল।
বুবুন একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে। চারদিকে তোলপাড় হওয়া ভাঙাচোরা ঝোপঝাড়। বুবুনের চোখে নতুন স্বপ্ন... ধীরে ধীরে সে তখন বাড়ি ফেরার রাস্তায়...
[ছবি Suman]