Skip to main content

ফুল ফুটলে ভ্রমর আপনিই আসে।

দক্ষিণেশ্বরের ঘর। প্রদীপ জ্বলছে। খাটে বসে গদাধর চট্টোপাধ্যায়। পূজারী। সাধন পথে নতুন নাম, রামকৃষ্ণ।

২০২৩ সাল। ভক্ত দরজার কাছে বসে। এখন ঠাকুরের ঘরের ভিতরে যাওয়ার নিয়ম নেই। কালী মন্দিরে, কৃষ্ণ মন্দিরে, শিব মন্দিরে আরতি হয়ে গেছে। কালীপুজো গেছে দু'দিন হল। এখন কালীপুজোর নবমী নিশি কবে কে জানে? রোজ সকালে উঠে দেখতে হয় প্যাণ্ডেলে প্রতিমা আছে? বেলা বাড়লেই প্রাণ অতিষ্ঠ করা মাইক। এখনও মাইকে আওয়াজ আসছে। দূর থেকে কোথাও ভেসে আসছে আওয়াজ। “আর কত রাত একা থাকব”.... ”চিরদিনই তুমি যে আমার”। ঝমঝম করে ট্রেন গেল। পাশেই বালিব্রীজ।

খাট শূন্য। কিন্তু শূন্য নয়। কান পাতলেই কথা শোনা যাচ্ছে। গান শোনা যাচ্ছে।

ভক্তের মনে কোনো কথা নেই। কথা বলার জন্য আসেনি সে। কথা শোনার জন্যেও না। চুপ করে বসার জন্য এসেছে। মন চুপ করলে হৃদয়ের আওয়াজ শোনা যায়। যেন অন্ধকারে তিস্তার পাড়ে দাঁড়িয়ে। নদী দেখা যায় না। শব্দ শোনা যায়।

এত জায়গা থাকতে এখানে কেন?

এখানে কোনো প্রপাগাণ্ডা নেই। অ্যাজেণ্ডা নেই। বিবেকানন্দ চিঠিতে লিখেছেন, তাঁর শিক্ষা নিলেই হবে, তাঁকে না মানলেও ক্ষতি নেই।

তাঁকে না মেনে তাঁর শিক্ষা মানা যায়? ধর্মে তো প্রমাণ বলতে যা বোঝায় সে তো একমাত্র যিনি বলেন তাঁর উপরেই দাঁড়িয়ে। অমুকে বলেছেন তাই এটা সত্য। অমুককে বাদ দিলে তো সত্যের দাঁড়াবার জায়গাই নেই। এ হয় নাকি?

মাষ্টার মশায় এসেছেন। ঠাকুরের কাছে থাকবেন ক'দিন। ঠাকুর বলছেন, সাধন করতে করতে মনই গুরু হয়। মনই জানিয়ে দেয়, এই এই, এইটা ঠিক রাস্তা।

এটা হয়। অঙ্ক শিখে নিয়ে করতে করতে একটা আন্দাজ তৈরি হয়। মন বলে দেয় অঙ্কটা ভুল হচ্ছে না ঠিক হচ্ছে। এও কি তাই?

মন ধোপাঘরের কাপড়। যে রঙে ছোপাবে সেই রঙ ধরবে।

বিশ্বাস, না গুরুবাক্য, কি?

গুরু তো মন। যদি ভাবের ঘরে চুরি না থাকে।

মন্দির ফাঁকা হচ্ছে। দু'দিন আগে এখানে লোক ধরার জায়গা ছিল না। মন আসক্ত নয়। মন উদাস। মন উদাস হলে মন থাকে না। বুদ্ধি উদাস হলে বুদ্ধি থাকে না। হৃদয় হয়ে যায়। হৃদয় চিরটাকাল উদাস। নামে, যশে, কামে, ধর্মে কিছুতেই হৃদয় বাঁধা পড়ে না। মানুষ চায় হৃদয় শান্ত হোক। তৃপ্ত হোক। হৃদয় উদাস। মন, বুদ্ধি হৃদয়ের উদাসীনতার সুযোগ নেয়। ছল করে। ঘোরায়। হৃদয় দেখে। কিছু বলে না।

একদিন মানুষ টের পায়। আসলে সে উদাসী। হৃদয়ের উদাসীনতা আজন্মকালের। উদাস না হলে শোকের সামনে দাঁড়ানো যায় না। ভয়ঙ্কর যা কিছুর মুখোমুখি হওয়া যায় না। প্রতিদিন বাচ্চারা অসহায়ের মত মারা যাচ্ছে। তাও মানুষ বাঁচতে চাইছে। তাও মানুষ চাইছে নতুন সকাল হোক। সব শান্ত হোক। মানুষের হৃদয় উদাস বলেই পারছে। নইলে একরাত্রে সব শেষ হয়ে যেত গণ আত্মহত্যায়। বুদ্ধির অহংকার, ধনসম্পদের অহংকার, লোভের আস্ফালন উদাসীনের সামনে শূন্য। এত মৃত্যু, এত হাহাকার, এত যন্ত্রণা সব দেখছে উদাস দুটো চোখ। একদিন অতি নিষ্ঠুরও এই উদাসীনতার সামনে এসে হেরে যায়। মহাকাল তাই এত উদাসীন।

এক আকাশ তারার নীচে এক শতাব্দী আগে দাঁড়িয়ে এক মানুষ। যিনি কিছু প্রচার করতে বলেননি। অনুভব করতে বলেছেন। কি অনুভব করবে? কোনো পুরাণের দেবদেবীকে? কোনো স্বর্গের দেবদেবীকে? না। পাশে দাঁড়িয়ে সে কাঁধে হাত রেখে বলছে, নিজেকে সব প্রপাগাণ্ডা থেকে মুক্ত করো। একা দাঁড়াও। সম্পূর্ণ একা। সেই একাকীত্বের বেদীতে অবিকম্পিত শিখার আলোকে যা দেখো, সেই সত্য। তোমার সত্য। তোমার চেতনা। তার কোনো নাম হয় না। কোনো মত হয় না। তাকে প্রচার করা যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। সে অনুভবকে বর্ণনা করা যায় না, কারণ সে উচ্ছিষ্ট হয় না।