সৌরভ ভট্টাচার্য
2 February 2016
আটের দশকের কথা। তখন হাওড়ার সালকিয়ায় থাকতাম। প্রাইমারী স্কুলে যাওয়ার পথে
একজন মুচীকে দেখতাম। হিন্দীভাষী, খুব সম্ভবত বিহারী কি উত্তরপ্রদেশের লোক
ছিলেন। কালো, স্থূলকায়। রোজ সকালে দেখতাম, হাঁটু অবধি লুঙ্গীটাকে গুটিয়ে বড় নর্দমার
উপর একটা কাঠের পাটাতন পেতে, এক রকমের লোহার ত্রিফলার (মুচীদের কাছে ওই
জিনিসটা দেখা যায়,
বিভিন্ন মাপের জুতো ওতে ঢুকিয়ে কাজ করা যায়, কি নাম
ওটার জানি না) মধ্যে জুতো আটকিয়ে মন দিয়ে কাজ করছেন, আর গুনগুন করে রামধুন
গাইছেন। জ্ঞানত রামধুন বোধহয় ওই আমার প্রথম শোনা। সারা রাস্তার ব্যস্ততা, দৌড়াদৌড়ি, উদ্বেগ
কিছুই ওনার হাসিখুশী মুখটাকে স্পর্শ করত না। ছোটবেলায় অত বুঝতাম না, তবে ওর
খুশী খুশী হয়ে কথা বলার ভাবটায় মনটায় বেশ আনন্দ হত। বেশ নিজের লোক বলে মনে হত। ওই
বয়সে যে পরিণত মানুষ ভয়ের কারণ না হন, তিনি বন্ধু হয়ে যান। আর যা হোক, ওনার
শাসনের চোখ কোনোদিন দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না।
পরে বাবার চাকরীর সুবাদে কাঁচরাপাড়ায় চলে আসলাম। কিন্তু আত্মীয়েরা যেহেতু রয়ে
গেলেন সালকিয়ায় তাই যাতায়াত থাকল নিয়মিত। কেন জানি না, আমি
প্রতিবারই কোনো না কোনো ছুতোয় ওনাকে দেখতে যেতাম। মাঝে মাঝেই দেখতাম উনি বিকালে
বসেন নি। ছোটবেলায় ভাবতাম হয়তো শরীর খারাপ হয়েছে, বা অন্য কাজ আছে। পরে
জানলাম কারণটা অন্য।
সেবারও সালকিয়ায় গেছি। বিকালবেলায় দেখি উনি নেই। এদিকে বসার সময় পাঁচটা পেরিয়ে
পৌনে ছ'টা বাজতে চলল। আমি পাশের মুদিখানার দোকানে জিজ্ঞাসা করলাম, "এই মুচীদাদু আসবে না?"
সে ঠোঙায় চিনি ঢালতে ঢালতে একবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে
বলল, "নাঃ, আজ আর আসবে না,
তুমি সামনে যাও, মোড়ে আরেকজন বসে এখন পেয়ে
যাবে।"
আমি বললাম,
"ওনার কি শরীর খারাপ?" মুদি বলল, "না না, আজ সকালেই তিরিশ টাকা হয়ে গেছে তা হলে।" আমি বুঝতে না পেরে বললাম, “মানে?" সে বলল,
"মানে হল ওর মাথায় ছিট আছে। ও কোনোদিন তিরিশ টাকার বেশি দিনে
কাজ করে না। বলে,
অত টাকা রাখার জায়গা রাম তাকে দেয়নি। বোঝো! কি পাগল!"
আমার হুট করে কেমন কান্না পেয়ে গেল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, কেউ
হয়তো চীৎকার করে ওকে গাল পাড়ছে তার জুতো সেলাই পছন্দ হয়নি বলে, কি
পেরেক যেটা ঠুকেছিল সেটা পায়ে বিঁধছিল বলে। তবে যে যতই চীৎকার করুক, উত্তেজিত
হোক, সে হাতজোড় করে বলত,
আপনি জুতোটা খুলিয়ে রাখেন, হামি এখনই ঠিক করে
দিচ্ছি।
আমি কি কখনো বিরক্ত হয়েছি ওনার কাজে? কটু কথা বলেছি? মনে
পড়ল না। এরপর থেকে তাকে দেখার চোখ আমার গেল বদলে। আগে প্রসন্ন হতাম তার মুখের
স্বর্গীয় প্রসন্নতায়,
এখন থেকে কণ্ঠের স্বর আপনিই নত হয়ে আসত ওনার সামনে। ওনার
চাহনির অর্থ বা গভীরতা কোনোদিন বুঝিনি, তবে অমন অতল শান্ত চোখের ভাষা
আমি তথাকথিত ব্র্যান্ডেড সাধুর চোখেও দেখিনি।
আজ এক যুগের বেশি হয়ে গেছে উনি নেই, তবু আমার একান্তের ধ্যানে ওনার
সেই প্রসন্ন মুখমণ্ডল আজও ভেসে ওঠে মাঝেমধ্যে। ক্ষুব্ধ মন শান্ত হয়। চিত্তশুদ্ধি
ঘটিয়ে দেয়। এমন দু'জোড়া চোখ আমার বিবেকের নিভু নিভু প্রদীপের শিখাকে বাড়িয়ে দিয়ে যায়। সন্তুষ্টি
কিসে? অনেক পেয়ে?
না চাওয়ার অবসান ঘটিয়ে চিত্তের মাধুর্যে?