রাত কত প্রহর? জানা নেই কারো। গোপীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখানে ওখানে বসে। বিমর্ষ। চিন্তিত। উদ্বিগ্ন। কৃষ্ণ কদমগাছের নীচে একাই বসেছিলেন। উঠে প্রধান গোপীর পাশে গিয়ে বসলেন।
- আমি জানি তুমি কেন চিন্তিত...
কৃষ্ণ গম্ভীর স্বরে বললেন, ধীরে। গোপী তাকালেন না। মাথাটা ভাঁজ করা হাঁটুর উপর রেখে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। জ্যোৎস্নায় ভিজে ঘাসের উপর একটা রঙীন পোকা হেঁটে যাচ্ছে ধীর পায়ে। গোপী হাতে করে পোকাটাকে তুললেন। অস্ফুটে বললেন, এরকম কেন হচ্ছে কৃষ্ণ?
কৃষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। যেন উত্তরটা খুঁজছেন, নাকি প্রশ্নটা থেকে সরে যেতে চাইছেন?
গোপী মুখ তুলে কৃষ্ণের মুখের দিকে তাকালেন। কৃষ্ণের হাতের উপর হাত রেখে বললেন, আমি তোমায় প্রশ্ন করছি কৃষ্ণ। এমন তো কথা ছিল না, না? এত অসহায় কেন আমরা? এত নির্যাতন, বলাৎকার কেন কৃষ্ণ? এই যে আমরা তোমার সাথে এই মধ্যরাতে নিত্য সংসারের থেকে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি, সেকি ভোগের জন্য? তা তো নয় কৃষ্ণ, তবে তো আমরা বেশ্যা হতাম, চরিত্রহীনা হতাম, তাই না কৃষ্ণ? আমরা এসেছি আত্মার টানে, দেহের ক্ষুধায় তো নয় কৃষ্ণ? তবে আজ আত্মার কণ্ঠস্বর দেহের ক্ষুধার কাছে, দেহের পাশবিক কণ্ঠস্বরের দাবীর কাছে বারবার কেন হেরে যাচ্ছে?
কৃষ্ণ নিরুত্তর। আকাশে তারাদের ধীর আবর্তন দেখছেন। আগাম ভবিষ্যতের ছবি ভাসছে যেন খণ্ড খণ্ড হয়ে সারা আকাশে। ধৃতরাষ্ট্র সিংহাসনে। পাশে উপবিষ্ট ভীষ্ম। মাঝসভায় চলছে পাশা খেলা। চুলের মুঠি ধরে রজঃস্বলা, একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে টানতে টানতে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে দুঃশাসন নিয়ে আসছে রাজসভায়। চতুর্দিকে কি অট্টহাসি! কি রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা! কি ক্ষোভ! কি চাপা উত্তেজনা!
কৃষ্ণ ধ্রুবতারাটাকে খুঁজছেন। চোখের সামনে ভেসে এলো ব্যাসদেবের মুখ, দুটো চোখ। ধীর, স্থির দৃষ্টিতে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে মহাকালের আসনে বসে। কৃষ্ণ তাকালেন। ব্যাসদেব, নীরবে যেন বললেন, হ্যাঁ, এটাই হবে। আমি লিখেছি। আমি দেখেছি। লেখক তো সাক্ষী, স্রষ্টা তো মহাকাল।
কৃষ্ণ চোখ নামিয়ে গোপীর দিকে তাকালেন। গোপী বললেন, বলো কৃষ্ণ, চুপ করে থেকো না, তুমি ভগবান!
কৃষ্ণ বললেন, ভগবান হতে পারি, কিন্তু বিধাতা তো নই!
- বিধাতা নও! তবে বিধাতা কে কৃষ্ণ? কেন বাকচাতুরী করছ দায় এড়াতে?
কৃষ্ণ বললেন, মহাকালের গতিপথের বেগ আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না সখী, আমি দ্রষ্টা, সাক্ষী। গতি নির্ধারণ করে মানুষ তার নিজের কর্মে, রুচিতে।
- তুমি তো অন্তর্যামী কৃষ্ণ, তুমি বাধা দাও না কেন সে বর্বর রুচিতে?
- বাধা দেওয়া আমার কাজ নয় গোপী, আমার কাজ সতর্ক করা। সে সতর্কবাণী উপেক্ষা করে চলার পরের ভার তো বিধাতার, আমার নয়!
- তুমি উদাসীন তবে? নির্মম? ওহ, কি নিষ্ঠুর তুমি!
তুমি থামাতে পারতে না নির্ভয়ার নির্মম অত্যাচার! এত এত নারীর নির্যাতনের পর কোন রাসের আহ্বানে ডেকেছো কৃষ্ণ? তুমি তো নপুংসক নও? তুমি সর্বশক্তিমান। তবে এত এত অত্যাচার কি করে দেখে যাও কৃষ্ণ?
কৃষ্ণ নিরুত্তর। গোপীর প্রতিটা বাক্য সত্য। গোপীর চোখ থেকে জল ভিজে মাটিতে ঘাসের উপর বিন্দু বিন্দু পড়ছে। তাতে পূর্ণিমা চাঁদের পূর্ণ প্রতিফলন। কৃষ্ণ বললেন, শোন প্রিয়ে, ভগবান অসহায় তার অন্তর্যামীত্বেই। যদি অন্তরের অন্তঃস্থলে নিজেকে জাগাতে না পারি, তাকে বাইরে ঠেকিয়ে কতদিন রাখা যায় গোপী?
- সে জাগানোর ভার কার কৃষ্ণ?
- তোমাদের গোপী। আমি মাধুর্য। আমি আনন্দ। আমি চিরন্তন শাশ্বত জ্যোতিঃ। তুমি যদি তাকাও, তুমি যদি চাও, তুমি যদি ডাকো, তবেই আমার অস্তিত্ব গোপী। নইলে আমি নিরাকার, শূন্য।
- এ কি অসম্ভব দায় তুমি দিচ্ছ কৃষ্ণ?
- তাই তো চেয়েছিলাম গোপী। দেবতা আর অসুরের লড়াইয়ে জয় চেয়েছিলাম মানুষের। মানুষ দেবতাও নয়, অসুরও নয়। কিন্তু কোনো একদিকে তার অতিরিক্ত ঝোঁকই তার প্রলয় ডেকে আনে। দেবলোকের আলস্য আর অসুরলোকের বর্বরতা - দুই যে অসামঞ্জস্য গোপী।
গোপীর চোখে-মুখে বিভ্রান্তির রেখা ফুটে উঠছে। তিনি ব্যাকুল হয়ে এদিক ওদিক পায়চারী করতে করতে কৃষ্ণের শান্ত মুখাবয়বের দিকে চাইছেন, আর মনে মনে বলছেন, সব মিথ্যা, সব চাতুরী তোমার, তুমি দায় এড়াতে চাইছ। এড়াও, কিন্তু ভাবীকাল তোমাকেই দায়ী করবে কৃষ্ণ!
কৃষ্ণ বললেন, জানি। দায় এড়িয়ে চলার জন্যেই আমাকে আহ্বান গোপী। ইচ্ছার দায় তার নিজের, কিন্তু লোভের দায়, রিপুর দায় যে চিরটাকাল আমাকেই নিতে হয়েছে গোপী, হবেও। জানি। কিন্তু তবু আমি অসহায়। ওই বললাম, আমার অসহায়ত্ব আমার অন্তর্যামীত্বেই। ভিতরে না পেলে, বাইরের চোখ ভোলানো ধাঁধাঁয় আমি নেই গোপী!
গোপী এদিক ওদিক চাইল। বাঁশি খুঁজছে। কৃষ্ণের মাথার শিখীপাখায় আঁকা যে চোখ, সে যেন অভিমানে তাকিয়ে তার মুখের দিকে। সে যেন বলছে, এ মাধুরীলীলায় কেন ভর্ৎসনা করো প্রভুকে? প্রভুকে মুক্তি দাও কাঠগড়া থেকে, তাকে চিত্তে ডাকো প্রেমিকের সাজে। তাকে প্রেমিকের বেশে ডাকো, আসামীর বেশে নয়!