১
---
রামভরণ তার পাঁচ বছরের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সামনে মথুরা বিল। চাঁদ উঠেছে বেশ কিছুক্ষণ হল। একটা বড় কাঁসার থালার মত চাঁদ জল থেকে কয়েক হাত উঁচুতেই। জল তো নয়, যেন গামলা গামলা দুধ ফেলা। রামভরণের বাড়ী বিহারের কোন এক অখ্যাত গ্রামে। রামভরণ বহু বছর হল বাড়ি যায় না। ভাইয়ে ভাইয়ে জমি নিয়ে অশান্তি তার আর ভাল লাগে না।
রামভরণের কোলে চুন্নু চাঁদের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে। তার মাথায় ছোট্ট দুটো বেণী। বেণীর মাথায় দুটো লাল ফিতে। চুন্নুর গায়ে সবুজ একটা ফ্রক। ক’দিন আগেই ছটপূজো গেছে। এটা ছটপূজোয় কেনা। চুন্নু একবার ওর বাবার মুখের দিকে তাকালো, তারপর আঙ্গুল দিয়ে চাঁদটা দেখিয়ে বলল, “চাঁদ...”। চুন্নু ‘চন্দা’ বলে না। রামভরণ কাঁচড়াপাড়া রেলওয়ে ওয়ার্কশপে কাজ করার সুবাদে কাঁচরাপাড়াতেই কোয়াটার্সে থাকে। তার পাশের কোয়াটার্সের মুখার্জীদাদের সাথেই চুন্নুর সারাদিনের ওঠবোস। তাই চুন্নু বাংলাই বেশি বলে।
মথুরা বিলটার উপর দিয়ে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে। বড় বড় লরি ছুটছে ব্রীজটা কাঁপিয়ে। রামভরণ ঘড়ি দেখল – আটটা দশ। ঠান্ডাটা পড়ব পড়ব করেও পড়েনি এখোনো। রামভরণের নিজের গ্রামের কথা মনে পড়ছে। বাবা মা, ভাই বোন, ধু ধু মাঠ, চাষের ক্ষেত, গোয়ালঘর, হনুমানজীর মন্দির... এইসময় গ্রামটাকেও নিশ্চই এই চাঁদটা এইভাবেই দুধের সরে ঢাকছে। বাবা-মা মারা গেছে বহুদিন হল। তার তিন ভাই নিজেদের জমি বুঝে নিয়ে নিজেদের মত থাকে। চাঁদের আলো জমির ভাগ বোঝে না, রাজ্যের ভাগ বোঝে না, মানুষে মানুষে ভাষার বিভেদ বোঝে না। মুখার্জীদার মুখটা মনে এল। রামভরণের বউ কনকের যেবার টাইফয়েড হল, মুখার্জীদা আর তার বউ যা করেছিল সে ঋণ রামভরণ কোনদিনও শুধতে পারবে না। তখন তো তারা সদ্য বাংলায় এসেছে। নতুন চাকরী, নতুন জায়গা, এমনকি কনকও তো নতুন। চুন্নুর ভাল নামও মুখার্জীদার বউয়ের দেওয়া – জাহ্নবী। জাহ্নবী রামনবমীর পরের দিন জন্মায়।
২
---
জাহ্নবী এখন আইএএস অফিসার। উত্তরপ্রদেশের কোন এক জায়গায় পোস্টিং শুনেছি, সঠিক জানি না। রামভরণকে বেশ কয়েক বছর আগে দেখেছিলাম কারখানার গেটের সামনের চায়ের দোকানে। তার স্ত্রী মারা গেছে বছর পনের হল। সে আর দেশে ফিরে যায় নি। চেহারায় বার্ধক্য তাড়াতাড়ি নেমে এসেছে। চোখেমুখে একটা ক্লান্তির ছাপ। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। একটা ক্ষতবিক্ষত মন নিয়ে বাইরের জগতটার সাথে যুঝে চলেছে। একটা পাউরুটি এক গ্লাস চায়ে ডুবিয়ে অন্যমনস্কভাবে খাচ্ছে। রাতে আর কিছু খাবে না। আমায় বলল, মুখার্জীদা আর তার মিসেস দুজনেই মারা গেল। রিটায়ারের পর আমরা একসঙ্গে থাকব ভেবেছিলাম। একসাথে জমি কিনলাম হালিসহরে (‘স’ টা sh নয়, এখোনো s আছে)... সবাই ফাঁকি দিয়ে চলে গেল।
রামভরণের নীচের ঠোঁটটা কয়েক টুকরো পাউরুটি মাখা হয়ে থরথর করে কাঁপছে। পাউরুটির গুঁড়ো তাঁর ময়লা প্যান্টের ওপর এসে পড়ল। চোখটার কোল মুহুর্তে জলে ভরে এল। তার সে ‘সবাই’য়ের মধ্যে বুঝেছিলাম তার স্ত্রী’ও আছেন। কিন্তু যে আধঘন্টা কথা বললাম, তাতে বুঝলাম সে তার স্ত্রীয়ের প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে চায়। অনেক অভিমান তার বুকে। বলার লোক নেই। না বাংলায়, না তার দেহাতি ভাষায়। তার মেয়েকে নিয়ে তার অনেক গর্ব। পড়াশোনায় অনেক এগিয়ে। গর্ব যতটা বেশি, নৈকট্য ততটা নয়। তার মেয়ে তার অফিসের বড় সাহেবদের চেয়েও ভাল ইংরাজী বলতে পারে। রামভরণ ইংরাজী বলতে পারে না। এটা দেশের ভাষা নয়। বললাম, বাড়ীতে আসবেন একদিন কাকু।
অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, আসব। আপনি ভাল আছেন?
রামভরণ ছোট-বড় সবাইকেই আপনি বলে – "কেয়া জানে কীস ভেস সে রামজী মিল যায়।" রামজী বাংলা বলতে পারেন, হিন্দী বলতে পারেন, রামজী ইংরাজী বলতে পারে না। রামভরণও পারে না, রামভরণ চায়ও না।
৩
---
আজ শুনলাম রামভরণ মারা গেছে। মৃত্যুর কোন পরিচয় লাগে না। সব মৃত্যুই পরিচিত, বিস্ময়ের, যন্ত্রণার। জাহ্নবীর কেমন লেগেছিল বলতে পারি না, কিন্তু রামভরণের চলে যাওয়াটা আমার দেশের একটা সংস্কৃতির অধ্যায়ের শেষ হওয়ার মতন মনে হল। তখন এত চ্যানেল ছিল না, মোবাইল ছিলই না, টেলিফোন থাকত কয়েকটামাত্র বাড়ীতে, খবরের কাগজগুলো সাদা-কালো। কিন্তু মানুষগুলো যেন অনেকটা বেশি নিজেদেরকে পেত।
রামভরণকে আমি কোনদিনই তার দেশে যেতে দেখিনি। কিন্তু তার গ্রামের সবক’টা অনুষ্ঠানকে সে তার কোয়াটার্সের আঙ্গিনাতেই নিয়ে এসেছিল। সে যে পুরো বাঙালী হয়ে গিয়েছিল তা নয়। নিজের সংস্কৃতির অস্তিত্ব খুব নম্রতা আর নিষ্ঠার সঙ্গে ধরে রেখে বাঙালী সমাজকে আলিঙ্গন করেছিল। তার তুলসীদাস আমাদের কৃত্তিবাসের সঙ্গে মিশেছিল। তার রাম-সীতা-লক্ষ্মণ-হনুমান দোভাষী হয়ে উঠেছিল। মুখার্জী এবং তাঁর স্ত্রী তার কাছে হর-পার্বতী তুল্য।
আজ মথুরা বিলে জল কমেছে। রাস্তায় গাড়ীর সংখ্যা বেড়েছে। আধুনিক সিগন্যাল বসেছে। টোল ট্যাক্সের আধুনিকীকরণ হয়েছে। কয়েক দশক পর মথুরা বিলের ওপর সেই ব্রীজে আজ আমিও দাঁড়িয়ে অনেক সংশয়ে, কিছুটা নিরাপত্তাহীনতায়। চাঁদটার ব্যাস কমেনি। কিন্তু তার সাদা রঙ আজ আর তত সাদা নয়। বাতাস অনেক বেশি দুষিত। দূষণ যে শুধু রক্তে ছড়াচ্ছে তা তো নয়, স্নায়ুতে স্নায়ুতে বইছে। আমি জাহ্নবী কোলে রামভরণকে খুঁজছি। যে আমার দেহাতি ভারতকে এনে দেবে। যে ভারতে আমি স্বচ্ছন্দে ভাষা বদল করেও নিজের অস্তিত্বকে নিয়ে বিপন্ন বোধ করব না। যেমন রামভরণ করেনি।