দরজাটা ভেজিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। ভিতরে ছ মাসের বাচ্চাটা আর বউ ঘুমাচ্ছে। এই আশ্বিনে এত বৃষ্টি কীসের রে বাবা।
ভুগো ছাতাটা খুলে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। কাঁচা রাস্তা। বৃষ্টিতে কাদা কাদা পুরো। ভর দুপুরেও মনে হচ্ছে যেন সন্ধ্যে নেমেছে। এই রাস্তাটা ধরে আধঘন্টা পশ্চিমে হাঁটলে বর্ধমান যাওয়ার রাস্তা। ভুগো ছাতাটা ধরে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। গরুটা ফেরেনি। কেন যে মরতে আজকে সকালে ছাড়তে গিয়েছিলাম!
ভুগো কয়েক পা রাস্তা ধরে এগিয়ে মাঠে নেমে পড়ল। বৃষ্টিটাও বাড়ল সাথে সাথে। ভুগো ছাতাটা বুকের সঙ্গে সিঁটিয়ে একটা বিড়ি ধরালো। অনেক ভাগ্য যে একবারের চেষ্টাতেই দেশলাইটা জ্বলে গেল। নইলে সব কাঠি যা মিইয়ে যায় এই বৃষ্টিতে।
ভুগো হাঁটছে। ভুগোর শরীরটা খুব যত্ন নিয়ে গড়েনি প্রকৃতি। রোগা বেঁটেখাটো মানুষ। গায়ের রং চাপা। ছোটোবেলায় ভীষণ ভুগত বলে নাম ভুগো।
পা দেবে দেবে যাচ্ছে কাদায়। কিন্তু মুশকিল হল বৃষ্টিটা এত বেড়ে গেল যে সামনে কিছু দেখা যায় না। ভুগো কোনো মতে সামনের দিকে এগোতে লাগল আর “ছুয়া”.....,”এ ছুয়া” বলে ডাকতে লাগল। ছুয়া ভুগোর গরুর নাম। সদ্য একটা বাছুর মরেছে ওর। ভুগোর কেন জানি মনে হয় ছুয়া আর বেশিদিন বাঁচবে না।
ভুগো দুবার পড়তে পড়তে সামলালো। আর তো হাঁটা যায় না। বাঁদিকে এগিয়ে গিয়ে অশ্বত্থগাছের তলায় শিবমন্দিরে এসে দাঁড়ালো। ছাতাটা বন্ধ করে মন্দিরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখল। বিড়িটা নিভে গেছে। সেটা ফেলে দিয়ে একবার উঁকি মেরে মন্দিরের উদ্দেশ্য প্রণাম করে বলল, বাবা….ছুয়া….পাচ্ছি না। দেখো না একটু। ও দুধ দেয় না। কিন্তু মায়া পড়ে গেছে, জানোই তো। বাচ্চা মরা মা। দেখো না। ওদিকে রেললাইন। ভয় হয় বাবা।
কয়েকটা আশঙ্কার দৃশ্য কল্পনা করে ভুগোর মনটা দমে গেল। বসে পড়ল মন্দিরে। বাচ্চাটার কথা মনে পড়ছে। কেন জানি হঠাৎ মনটা কেমন করতে শুরু করল ভুনিয়ার জন্য। ভুনিয়া, তার ছেলের ডাক নাম। ভালো নাম নয়ন। ওর মায়ের পছন্দ।
বাবা, করবী যদি না থাকে, ভুনিয়া যদি না থাকে। তবে আমি কে? কেউ না। ছুয়ারও তো তাই, বলো। ওর চোখের দিকে তাকালে আমার বুকটা ফেটে যায়। অবলা পশু। কী যে ব্যথা। তোমার মনে আছে, আমাদের বোবা কাকিমার কথা। আমি তখন ছোটো। তুমি তো দেবতা, তোমার আবার ছোটোবড়ো কী। সেই কাকিমার ছেলেটা সাপে কেটে মরল। কাকিমা….কেমন গোঁ গোঁ করত তোমার এই থানে শুয়ে….শেতলা তলায়…মনে আছে? তারপর বিষ খেল। ছুয়া কি বিষ খেতে পারে, ইচ্ছা করে ট্রেন লাইনের দিকে চলে যেতে পারে?
ভুগোর চোখ জলে ভরে এলো। বৃষ্টিটা থামার নাম নেই। এদিকেই আসে ছুয়া, ওই সামনের মাঠটায়।
ভুগোর মাথায় কীসের ছোঁয়া লাগল। চমকে পিছনে তাকালো। কেউ নেই তো। তবে? হঠাৎ একটা দমকা বাতাস ভুগোকে যেন ঠেলে ফেলে দিতে চাইল মন্দির থেকে। ভুগো বাইরে ভালো করে তাকিয়ে দেখল, ঝড় উঠছে নাকি?
না। কিন্তু বৃষ্টিটা হঠাৎ দুই ফাঁক হয়ে মাঝখান থেকে একটা সরু রাস্তা করে দিল। দুই ধারে বৃষ্টির পাঁচিল। মধ্যে রাস্তা। কেউ বলল, যা ভুগো…যা।
ভুগো উঠল। ছাতাটা ভুলল। নেমে গেল মাঠে। দুইধারে মুষলধারে বৃষ্টি, ভুগো চলল মাঝখানের রাস্তা দিয়ে। কে যেন ডাকছে। ভুগো…আয়….আয়।
ক্রমে বৃষ্টির পাঁচিলটা সাদা বরফের পাহাড় হতে শুরু করল। ধবধবে জ্যোৎস্না। পাহাড়ি রাস্তা ধরে হাঁটছে ভুগো। শীত শীত করছে। রাস্তাটা গেছে কোথায়?
ভুগো বেশ খানিকটা হাঁটার পর দেখল একটা বড় চাতাল। তার উপরে বসে আছেন মহাদেব। তাকে দেখেই ডাকলেন, আয় ভুগো…আয়।
ভুগো ইতস্তত করছে, এই পোশাকে….হাতে কিচ্ছু নেই…..
ভগবান অন্তর্যামী। ভুগোকে বললেন, আরে আয় আয়….বাবার কাছে ওসব লাগে না। বোস। একগ্লাস দুধ খা। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এদিকে। জমে যাবি নইলে।
ভুগো দেখল মা মহামায়া একটা লালপেড়ে সাদা শাড়ি গায়ে, তার হাতে এক গ্লাস দুধ দিয়ে বললেন, খাও বাবা।
মহাদেব বললেন, কার দুধ বল তো? তোর ছুয়ার।…. দেখবি নাকি?....
ভুগো তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো। সে উত্তেজিত। ছুয়া আপনার কাছে? যাব যাব…কই সে?
মহাদেব নন্দীকে ডাকলেন, এই নন্দী….যা একে পিঠে চড়িয়ে দেখিয়ে নিয়ে আয় রে সব…..
ভুগোকে নন্দী পিঠে তুলে নিল। নন্দী চলতে শুরু করল। ভুগো দেখছে ওই যে তাদের গ্রাম। ওই যে বর্ধমান। ওই যে হাওড়া ব্রীজ। ওই যে জগন্নাথ মন্দির।
ওই দ্যাখো….নন্দী বলল।
ভুগো দেখল, সবুজ কচিঘাসে ছাওয়া মাঠে ছুয়া আর তার বাছুরটা বসে আছে। তার পিঠে ছোবা দিয়ে ঘষছে তার সেই বোবা কাকিমা। তাকে জল এগিয়ে দিচ্ছে তার ছেলেটা, মগা।
ভুগোর দুই চোখ জলে ভরে এলো। সে এক লাফে নন্দীর পিঠ থেকে নেমে ওদের দিকে দৌড়াতে যাবে….হঠাৎ বৃষ্টি নেমে গেল।
ভুগো দেখল সে মন্দিরের চাতাল থেকে গড়িয়ে পড়েছে মাঠে। বৃষ্টি এখনও ধরেনি। উঠে দাঁড়ালো। মন্দিরের দিকে ফিরল। ছাতাটা নিল। ছাতাটা বন্ধ করেই হাঁটতে শুরু করল। স্বপ্নের ঘোরটায় মাথাটা ধরিয়ে দিয়েছে। ভালোও লাগছে, আবার খুব খারাপও লাগছে। সব কি মনের মধ্যে থেকে যায়? কোথায় থেকে যায় বাবা? মনের মধ্যে ক'টা মন বাবা?
ভুগোর সব কিছু কেমন অন্যরকম লাগতে লাগল। চারদিকটা যেন চাপচাপ স্বপ্ন। তার ভাবনার সুতোয় বোনা। যেন সে এখনও স্বপ্ন দেখছে।
বাড়ি এলো। বৃষ্টিটা ধরেছে। ওরা এখনও ঘুমাচ্ছে। খাটালের দিকে গেল। ছুয়া আসবে নিশ্চয়ই। আর না এলেই বা কী! একদিন না একদিন তো যাবেই। সবাই যাবে। ভুগোর মনটা খারাপ হল না। ভুগো ভয় পেল। তাড়াতাড়ি গিয়ে বাচ্চাটার পাশে শুলো। তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল, কেউ কোত্থাও যাবে না….কেউ না…..
বাইরে হঠাৎ ভীষণ জোরে বাজ পড়ল। ভুগো উঠে বসল। তার বউ উঠে বসল। বাচ্চাটা কেঁদে উঠল। গ্রামের এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে চীৎকার শুনতে পাচ্ছে। কাছেই পড়েছে কোথাও। ছুয়াটা মাঠে! ভুগো অপলক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে। কোথায় যায় মানুষ! রাখে..না ছাড়ে….