আমার পড়ার ঘরে, একতলায় আছি। একটা বইতে ডুবে আছি। হঠাৎ শুনতে পেলাম উপরের তলা থেকে কেউ বলছে, "আমি তো বেইমান। মানুষমাত্রেই বেইমান।"
গলাটা বাবার দেখাশোনা করতে আসা অস্থায়ী আয়ার। যিনি নিয়মিত থাকেন তিনি কদিনের ছুটিতে আছেন। আমি আবার কান পেতে শুনলাম, কথাটা নিশ্চয়ই ফোনে হচ্ছে। কারণ এক, বাবা বেশি কথা বলার মানুষ নন, দুই, বাবাকে এসব বলার কোনো কারণই নেই।
ইতিমধ্যে বাবার ফোন দোতলা থেকে... "হ্যাঁ রে, এ কার সঙ্গে কথা বলে কাঁদছে এরকম?"
আমি এম এন শ্রীনিবাসের "ভারতীয় সমাজকে" টাইমস অব ইণ্ডিয়ার উপর উপুড় করে উপরে উঠলাম। সত্যিই তো উনি এভাবে কান্নাকাটি করে কাকে এসব বলছেন। সে যাকেই বলুন, কিন্তু পাশে একজন অসুস্থ মানুষ, তার মানসিক চাপ তো হবে নাকি!
সিঁড়ি দিয়ে অর্ধেক উঠেই থমকে গেলাম। দেখলাম উপরের বারান্দার জানলায় মোবাইল রাখা, আর অস্থায়ী আয়া যিনি, তিনি দুই হাত রিও দ্য জিনারিওর যীশুর স্ট্যাচুর মত দুই দিকে প্রসারিত করে উক্ত সংলাপটা বলতে বলতে দুলকি চালে মোবাইলের চলন্ত ক্যামেরার দিকে এগিয়ে চলেছেন।
বুঝলাম রিল নির্মাণ হচ্ছে। এখন নিজে লেখালেখি করি, শিল্পীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করাটা কি ঠিক? কি সংকট। কি করি। বাকি সিঁড়িটা উঠে, বাবার ঘরে ঢুকলাম। বলাবাহুল্য আমায় রিল নির্মাতা খেয়ালও করলেন না।
বাবা বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ রে, একই কথা ও বার কুড়ি বলেই যাচ্ছে... একই ভাবে কেঁদে কেঁদে.... ও কি পাগল?!
বাবার মুখের ভঙ্গি আর শেষের আশঙ্কাজনক সিদ্ধান্তের কথাটা শুনে আমার পক্ষে আর হাসি চাপা গেল না। বাবা ফেসবুক, ইনস্টা ইত্যাদি কিছুই বোঝেন না। অগত্যা আমি দুটো রিল চালিয়ে বললাম, এই... এই জিনিস বানানো হচ্ছে।
বাবা দু-একটা দেখে বললেন, ওহ! থাক থাক। বানাক। এ বানিয়ে কি হয়?
কিন্তু দু-একটা রিল ইতিমধ্যেই যা চলে এসেছে বাবা আর রিলের প্রসঙ্গ বাড়ালেন না। আমিও বাবার ঘর থেকে বাইরে এসে দেখি শিল্পী চেয়ারে বসে বসে সদ্য নির্মিত রিলটি বেশ আত্মতৃপ্তির সঙ্গে দেখছেন।
আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম, রিল বানাচ্ছিলেন বুঝি?
তিনি একগাল হেসে বললেন, হ্যাঁ দাদাবাবু, আপনি আছেন ইনিস্টিয়ায়...
না না, আমি কোনো ইনিস্টিয়ায় নেই।
মিথ্যা বললুম। পাছে যৌথ উদ্যোগে রিল বানানোর প্রস্তাব আসে। বলা তো যায় না!
নীচে এসে আবার এম এন শ্রীনিবাসকে সোজা করে কোলে রাখলাম। কিন্তু পড়ব কি, বাবার ওই সতেজ প্রশ্ন - ও কি পাগল! কথাটা যতবার মনে পড়তে লাগল, ততবার হাসতে হাসতে আমার পেটের মাংসপেশিতে টান ধরার উপক্রম হল। এই রিলের চক্করে আবালবৃদ্ধবনিতা পাগলামির দোরগোড়ায় এসেছে বাবা... সব পাগল হচ্ছি.... ক্যামেরার মুখ যদ্দিন ওদিকে ছিল তদ্দিন নানাবিধ সৃষ্টি ছিল। ক্যামেরার মুখ যেই না ওদিক ছেড়ে আমার দিকে ঘুরেছে... ব্যস। তবে ক্যামেরাই বা বলি কেন, যা কিছুই হোক, তা যদি দশদিশি ছেড়ে সেল্ফিসি হয়, তো পাগল দশা হয় না মানুষের? মেগালোম্যানিয়াক ইত্যাদি কি সব বলত না আগে.... তারই তো নতুন ভারসান এ। নিজেকে নিয়ে বেশি মাতামাতি করেছ কি পাগল হব হব হয়েছ.... এ তো আদ্যিকালের কথা.... অগত্যা আধুনিকতাকে বরদাস্ত করাই শ্রেয় ভাবলাম।
জীবনকে কোনোদিন সমস্যাহীন করার চেষ্টা করিনি। কারণ, ও হয় না। কিন্তু সমস্যাটা যতটা কম ক্ষতিকারক হয় সে চেষ্টা চালিয়ে গেছি বা যাচ্ছি প্রতিদিন। অগত্যা তিনি যখন নীচে নামলেন, বললাম, সে রিল বানান অসুবিধা নেই, খালি বাবা যখন ঘুমাবেন বানাবেন না, আর যখন জেগে থাকবেন দরজাটা বন্ধ করে নেবেন।
তিনি এক মুখ রৈলিক হাসি হেসে বললেন, আচ্ছা দাদাভাই!