Skip to main content
 
       মেয়েটা যে রাস্তা দিয়ে রোজ লাইব্রেরী যেত, সেই রাস্তায় একটা চায়ের দোকান, একটা সাইকেল সারানোর দোকান, একটা জুতো সারানোর টালির ঘর, একটা মিষ্টির দোকান, আর তার বাড়ি পড়ত। মেয়েটা প্রতিদিন বিকালে ৫.২৫ নাগাদ তার বাড়ির সামনে দিয়ে যেত। সে জানলার ওপাশে বসে থাকত। শীতকালে দরজায় বসত। বর্ষাকালে জানলাটা একটু ফাঁক থাকত। ভিতরটা অন্ধকার। কিন্তু মেয়েটা জানত, সে দেখছে। বৃষ্টির ছাঁটে চোখমুখ ভিজে যাচ্ছে তার, তবু সে দেখছে।
       বুধবার লাইব্রেরি বন্ধ থাকত। মেয়েটা সারাদিন ছাদে থাকত। দূরে ওদের বাড়ির ছাদ দেখা যেত। যদিও একটা বটগাছে ঢাকা পড়ে যেত ওদের ছাদের দক্ষিণ দিকটা। তবু সে তাকিয়ে থাকত। ওদের ছাদের উপর কাক বসলে সে কাকের উপর ঈর্ষা হত। আবার ভালোও লাগত। ওদের ছাদের উপর কাটা ঘুড়ি পড়লে মেয়েটার মন খারাপ লাগত। যে বুধবারে খুব বৃষ্টি, সে সিঁড়ির ঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদত। সেই একটু ফাঁক করা জানলা দিয়ে তার অল্প অল্প গোঁফের রেখা মনে করত। তার ঠোঁটদুটো যেন তিরতির করে কাঁপছে। যেন সে এমনভাবে জড়িয়ে আছে ছেলেটাকে, যে তার হুইলচেয়ারটা সমেত তার ভিতরে মিশে যাচ্ছে। সেও যেন কাঁদছে। তার কান্নার শব্দ সে তাদের বাড়ির ছাদে পড়া অবিরাম বৃষ্টির ধারার সাথে শুনতে পাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছে। বটগাছটা ঝোড়ো হাওয়ায় পাগলের মত যেন তাকে ডাকছে, আয় আয় আয়।
       কোনোদিন যাওয়া হয়নি। ছেলেটা মারা গেল একদিন, বর্ষাকালেই। মেয়েটার মা বলল, ও তো মারাই যেত। প্রচণ্ড অসুস্থ ছিল যে। সেদিন মেয়েটার চোখে যেন কোথা থেকে কামড়ালো কি এক বিশ্রী পোকা। চোখ হল এত ফোলা। এত লাল। তবু এমন জেদি মেয়ে ডাক্তারের কাছে গেল না। লাইব্রেরি গেল ওই চোখ নিয়ে। ফিরল যখন মুখের দিকে তাকানো যায় না। ছাতাটা পর্যন্ত খোলেনি। কাকভেজা হয়ে ফিরল। বাড়িতে সবার বকা খেল। চোখদুটো রক্তজবা। মুখটা ফোলা। রাতে বলল, খাবে না কিছু। সকালে এল ধুম জ্বর। হবে না এত জলে ভিজলে? তবু মেয়েটা গেল না ডাক্তারের কাছে।
       ছেলেটার শ্রাদ্ধের প্যাণ্ডেল বাঁধা হল ছাদে। মেয়েটা সারাদিন ছাদ থেকে নামলই না। পড়ার বই নিয়ে মেঘলা আকাশের নীচে কাটিয়ে দিল সারাদিন। খেল না কিছু। শরীরটা ভালো নেই, বলে দিল সবাইকে। মা বিরক্ত হয়ে বলল, কি যে ঢং বুঝি না বাপু!
       এটা একটা কথা হল? মেয়েটা ভাবল সে নিজেও কি বোঝে! প্রতিজ্ঞা করল, আর কোনোদিন যাবে না ওই রাস্তায়। তবু গেল। হৃদয় তো জেদি, বুদ্ধির মত বুদ্ধিমান কি সে? বাড়িটার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তার বুকে জড়ানো লাইব্রেরীর ডেট পার হওয়া বইটা পড়ল রাস্তায়। আচমকাই। মেয়েটা হাঁটু মুড়ে বসল। ঝাপসা চোখে বইটা কুড়িয়ে উঠতে যাবে, কেউ একজন হাত রাখল পিঠে। না, কেউ না, বটগাছের একটা পাতা পড়ল, হলুদ হয়ে যাওয়া পাতা। কিন্তু পাতাটা যেন তার চোখের মত অবিকল। তার দিকে তাকিয়ে বলল, এত দেরি করে আসতে হয়?
       মেয়েটা পাতাটা কুড়িয়ে বইয়ের ভাঁজের মধ্যে রাখল। ঝাপসা চোখে বলল, এখন থেকে আমার সাথে রোজ যাবে লাইব্রেরি। হেঁটে হেঁটে। পাতাটা বলল, আর বুধবার?
       মেয়েটা বলল, বুধবার বলে কিছু নেই আর। আমি বন্ধ লাইব্রেরির পাশের মাঠে যাব, তুমি বর্ষায় কোনোদিন ভিজে মাঠে ভিজেছ? আমি ভেজাবো তোমায়। হুইলচেয়ারে ফিরতে দেব না আর।