Skip to main content
 
 
        অবশেষে আমরা পুতুলপূজায় বিশ্বাসী - যেভাবেই হোক। সে লেনিন হোক আর শ্যামাপ্রসাদ। মূল কথা হল আমাদের পুতুল আর আমাদের আদর্শ সমার্থক। একটি নড়লে আরেকটা নড়ে যায়। আমাদের বাদবাকি দিকগুলো মানে একটা শিক্ষিত সভ্য সমাজে যেগুলো নিতান্তই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়, সেগুলোতে আমরা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গেছি। নিন্দুকে যাই বলুক না কেন। যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, পানীয়জল, শৌচালয় ইত্যাদিতে। কর্মসংস্থানের কথা আর নাই বা বললাম। 
        ফলে আমাদের হাতে এখন অঢেল সময়। ক'দিন আগে অবধি আমরা ট্রাম্প আর কিমের টেনিস খেলা দেখছিলাম। একবার এদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আরেকবার ওদিকে। বেশ একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব মনের মধ্যে এসে গিয়েছিল। সে শো আপাতত বন্ধ। এখন আমাদের নতুন খেলা নব্য ভারত বনাম প্রাচীন ভারত। এ খেলাও বহু পুরোনো। মেলা বড় বড় খেলোয়াড় খেলে গেছে এই ফিল্ডেও। অদ্বৈত দর্শনের পদার্থ বিজ্ঞানের আলোয় বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, বর্ণাশ্রমের জিনগত ব্যাখ্যা, ব্রহ্মের আণবিক তত্ত্বের ব্যাখ্যা ইত্যাদি। খেলাগুলো পুরোনো হয়েছে। কিন্তু মুশকিল হল আমাদের নব্য ভারত আর প্রাচীন ভারত উভয়েই এই কোর্টের বাইরে গিয়ে খেলতে ভয় পায়। একপক্ষের দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য ধর্ম - ঈশ্বরকে নেই প্রমাণ করা; আর আরেক পক্ষের দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য গোটা ভারতকেই আধ্যাত্মিক আলোর ফোকাসে মেলে ধরা। মাঝখানে মানুষের কথা - লবডঙ্কা। অবশ্য ভারতের দর্শনে মানুষ কোনোদিনই মূলধারার দর্শনের বিষয় ছিল না। এক বুদ্ধের আগে তেমন করে কেউ ঈশ্বর হটিয়ে মানুষকে জায়গা দেওয়ার কথা বলেনি। কিন্তু বললে কি হবে, তার দর্শন যে আবার বড় বেশি নঞর্থক। ত্যাগ, নির্বাণ - এসব কথায় মৈত্রী ইত্যাদি রসাতলে গেল। আর এখন যেটিকে 'বৌদ্ধধর্ম' বলে দেখছি সে তো জলের সাথে এমন জল মেশানো যে স্বয়ং বুদ্ধবাবাজীও চিনতে পারবেন কি না সন্দেহ। 
        তো মানুষের কথা কেন্দ্রে রেখে এক গ্রীসের দার্শনিক ছাড়া প্রাচীন যুগে কে বলল বলো? আমাদের তো রূপক, আচার, নিষ্ঠা, সংস্কার ইত্যাদিতে মানুষের কন্ঠস্বর মেলা দিন হল চাপা। দেখোনি আমাদের মানুষের সেবা করতে তাকে শিবের খোলস পরে দেখতে হয়, আমাদের দেশের সেবা করতে তাকে 'মা' বলে জানতে হয়। আমাদের সবই বড্ড রূপকধর্মী। যেটা যে বস্তু আসলে, সেটাকে সেই অবস্থায় দেখতে আমাদের প্রেস্টিজে না কিসে লাগে ভগাই জানে। 
        বাস্তববুদ্ধি জাগায়, বাস্তব নীতিবোধ শক্তপোক্ত করে এমন কথা ছোটবেলা থেকে এ জাতটা কোথায় শুনলো বলো? হাজার একটা ধর্মগুরু, হাজার একটা আচার-বিচার, হাজার একটা অতীন্দ্রিয় জীবনদর্শন। কোটি টাকার প্যান্ডেল, ঠাটবাটে থাকা সন্ন্যাসী, লক্ষ টাকার মন্দির, দুর্নীতিগ্রস্থ আপাদমস্তক সামাজিক ক্রিয়াকান্ড, হাজার একটা যুক্তিহীন শ্রেণীবিন্যাস - সংরক্ষণ, একটা দেশে নানা শিক্ষাব্যবস্থা --- এত বৈষম্যের মধ্যে তার পক্ষে সহজ লড়াইয়ের পথ কি হতে পারে? পুরোনো শত্রুকে ধরে মারো। 
এখন পুরোনো শত্রু কে? খুব সোজা তো। হয় পাশ্চাত্য-ধার্মিক হও, নয় প্রাচ্য-ধার্মিক হও। পাশ্চাত্য ধার্মিক মানে কি? মানে হল যা কিছু ভারতজাত না, তাই মহান, বিজ্ঞানপ্রসূত; এতে কোনো দ্বিধা না রাখা। একজনের authority ছেড়ে আরেকজনের authority স্বীকার করে নেওয়া। ধর্ম মানে ঈশ্বর না, অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করা না। ধর্ম মানে যে কোনো কিছুকে অথোরিটিত্বের মর্যাদা দিয়ে তার পায়ের কাছে বসে পড়া। কোনো প্রশ্ন না করা। চূড়ান্ত আনুগত্যে সারাটা জীবন দিয়ে দেওয়া। 
        এই নিয়ে একটা মজার কথা মনে পড়ল। একজন আমায় বলল, গুরু হিসাবে কাউকে একবার স্বীকার করে নিলে নাকি তাকে আর ত্যাগ করতে নেই। আমি বললাম, আমি মানি না। সে বলল, মানো না মানে কি? স্বয়ং রামকৃষ্ণ বলেছেন, যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়, তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়। আমি বললাম, আমি রামকৃষ্ণ বললেও মানি না একথা। সে রীতিমতো আঁতকে উঠলো আমার স্পর্ধা দেখে। কারণ দুটো - এক, আমি রামকৃষ্ণের অথোরিটিত্বে অবিশ্বাস করছি; দুই, গুরুর প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যে বিদ্রোহ করছি।
        এইখানেই আমাদের জাতীয় স্তরের গোলমাল - প্রশ্নহীন আনুগত্য। কারন সে নিজেকে শুধু মানুষ হিসাবে কোনোদিন মূল্যবান, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ভাবতেই শেখেনি। আমাদের শিখতেই দেওয়া হয়নি। মানুষ হিসাবে আমার একটা গুরুত্ব আছে শুধু না, আমার মানবিকতার বাইরে কোনো ধর্ম, কোনো ঈশ্বর নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না আজকাল - এই কথাটা এখনও আমাদের বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয়। তাই আমাদের অনেক সমস্যাই মধ্যযুগীয়, তারাই আমাদের খবরের কাগজ, তর্ক-বিতর্ক জুড়ে থাকে। 
        কতগুলো কথা স্পষ্ট বুঝতে হবে:
        ১) বিবেক, চেতনা, নীতিবোধ - কোনো ধর্মপ্রসূত নয়, সে আমাদের মন্দির, বহু বাবাজীদের দেখলেই বোঝা যাবে। নৈতিকতা একটা দীর্ঘকালীন অভিব্যক্তিজনিত মানবিক বিকাশ। তা থাকবেই। 
        ২) মানুষের সমস্যা মানবিক স্তরেই মেটাতে হবে। কোনো আদর্শ, নীতি'র থেকে বড় কথা বাস্তববাদী, যুক্তিবাদী, তথ্য নির্ভরশীল হওয়া।
        ৩) ধর্ম আর রাজনীতির অবস্থান এক নয়। একটা ব্যক্তিগত, আরেকটা সমাজগত। যদিও কতটা ব্যক্তিগত তা WTC-র শূন্যস্থানটা দেখলে আতঙ্কিত হতে হয়। তাছাড়া আরো আরো আতঙ্কবাদ তো আছেই। তর্ক উঠবে ওটা আসল ধর্ম নয়। বুঝলাম সেটা। কিন্তু ওই সর্বস্বান্ত মানুষগুলোকে বোঝানো যাবে? আসলে যে জিনিসেরই দুটো-তিনটে ব্যাখ্যা হয় সেটা নিয়েই গোল পাকে। আপনার ব্যাখ্যা আর আমার ব্যাখ্যায় ঘোরতর দ্বন্দ্ব তৈরী হয়। সেটা কবিতার সংজ্ঞা, অর্থনৈতিক সংজ্ঞায় চার রকম কেন, লক্ষরকম হলেও গোল বাধে না। কারন প্রতিটার পিছনে যুক্তি আছে। অথোরিটি নেই। তাই তার একরকম সমাধানের পথও মেলে। 
        ৪) মানুষকে কেন্দ্রে না রাখলে সত্যিই বিপদ। মানুষকে বিজ্ঞানের আলোতে না দেখলে কোনো ভেদাভেদ কোনোদিন ঘুচবে না। মানুষের বিজ্ঞানগত রূপটা আবেগহীন নয়, সংবেদনশীল। সংবেদনা থেকেই যতকিছুর সৃষ্টি। এমনকি যদি ঈশ্বরের অস্তিত্বকেও স্বীকার করে নিই তর্কের খাতিরে, সেও আমার সেই সংবেদনের উপরেই দাঁড়িয়ে। শুধু বিশ্বাস ভয়ঙ্কর।
        রাজনীতি নয়, ধর্মনীতি নয়, একটা সুস্থ সমাজ গড়ে ওঠে একটা সুস্থ শিক্ষাপ্রণালীর মাধ্যমে। সুস্থ শিক্ষাপ্রণালী মানে শুধু ঠিকটা বলার চেষ্টা করেই ক্ষান্ত দেওয়া নয়; যারা ভুলটা বলছে, প্রচার করছে, সে পাশ্চাত্যধার্মিক হোক কি প্রাচ্যধার্মিক - তার নিরসনে প্রয়াস পাওয়া। মনে রাখতে হবে, আমরা এমন একটা দেশের নাগরিক যেখান একজন মানুষকে জলজ্যান্ত চিতায় তুলে পুড়িয়ে মারতে নেই বলতেও একটা মহাপুরুষ লাগে। অগত্যা তোমরা অমন মূর্তি ভাঙ্গাভাঙ্গি খেলো না বলতেও চিল্লাতে হবে। কারণ অথোরিটি'র সর্বোচ্চ অভিশাপ হল সে সংবেদনশীলতাকে নষ্ট করে ফেলে।