Skip to main content

পুটু প্রথম দুটো ক্লাসে মনই দিতে পারল না। মায়ের কাটা ঠোঁট, রক্ত, হাতে কালশিটের দাগ মনে পড়ছে খালি। বাবা অবশ্য আবার একমাস আসবে না। বাবা বহরমপুর কাজ করে। স্কুলে পড়ায় বাবা। তার মাও পড়ায়। বাচ্চাদের। তার বাবা পড়ায় বড়দের।

স্কুলে যখন স্যারেরা কোনো বাচ্চাকে মারে, কি পুটুকেই মারে, পুটু কুঁকড়ে যায়। মনে হয় বাবাই মারছে। ঠাকুমা, ঠাকুর্দা কেউ কিচ্ছু বলে না। কেন বলে না?

পুটু গলায় ঝোলানো ক্রসটা আঁকড়ে ধরে থাকে। বুকের কাছে ঠাণ্ডা লাগে ক্রসটা বুক ছুঁলেই। মেটালের বলে, রঞ্জিতা বলে। তার মাসির মেয়ে। পাশের বাড়ি থাকে। ওরা হিন্দু। বাইবেলে লেখা আছে, এক গালে চড় খেলে আরেক গাল পেতে দিতে। যীশু তা-ই বলেছে। মা রাতে শুয়ে গল্প করে। কিন্তু কেন? যীশুর সময় থানা ছিল না, পুলিশ ছিল না। এখন তো আছে। পুটু মাঝে মাঝেই ভাবে থানায় যাবে। অনেকবার গেছেও। একবার দরজা অবধি গিয়েও ফিরে এসেছে। একজনকে মারতে মারতে থানায় ঢোকাচ্ছিল। কাউকে মারতে দেখলেই পুটু অবশ হয়ে যায়। নড়তে পারে না। তার নাকি একটা বোন হওয়ার কথা ছিল। বাবার মারে সে নাকি মায়ের পেটে থাকতেই গড তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।

 

======

 

পুটু বাড়ি ফিরে এলো স্কুল থেকে। মায়ের চোখটা ফোলা ফোলা। মা আজকেও কেঁদেছে। ঠাকুমা ঠাকুর্দা চুপ করে থাকে। ঘর থেকে বেরোয় না। সে মাসির মেয়ের কাছে শুনেছে তার বাবা নাকি ঠাকুমা ঠাকুর্দাকেও মারত আগে। তার মা নাকি থামিয়েছে। তবু নাকি এখনও মারে।

পুটু ভাত খেয়ে ছাদে গেল। সে গডের কাছে প্রার্থনা করে রোজ। চোখ বন্ধ করে বসে। কিচ্ছু হয় না। বাবাকে কেউ মারুক সে চায় না। সে চায় বাবাকে কেউ আটকাক। কেউ কাউকে মারুক সে চায় না। সে চায় আটকাক কাউকে কেউ।

পুটু অনেকক্ষণ ছাদে বসে থাকল। নীচ থেকে রঞ্জিতা ডাকছে। পড়তে যায় সে আর রঞ্জিতা। পাশের পাড়ায়। হাসিদিদির কাছে। কলেজে পড়ে। ওর বাবা নেই। কি ভালো!

 

======

 

হাসিদিদি বুঝতে পারে পুটুর মুখ দেখলে। হাসিদিদি বলল, তুই বড় হয়ে পুলিশ হতে পারিস।

পুটু মাথা নাড়ল। সে পুলিশ হবে না।

হাসিদিদি বলল, তবে?

পুটু বলল, স্পাইডারম্যান। ছোঁ করে মাকে তুলে নিয়ে চলে যাব।

হাসিদিদি তার মাথার চুলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, সেই ভালো।

রঞ্জিতা বলল, আমি পুলিশ হব।

 

=======

 

পুটু রঞ্জিতাদের বাড়িতে একটা সিনেমা দেখছিল টিভিতে। একটা লোক কাগজ মাটি থেকে তুলে নিয়ে নিয়ে আগুনে দিচ্ছে। আর পুলিশ এসে বারবার তাকে মারছে। লাঠি দিয়ে। সে বারবার পড়ে যাচ্ছে। তবু উঠে উঠে দাঁড়াচ্ছে।

পুটুর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। কান্না পাচ্ছে। কেন লোকটা পালিয়ে যাচ্ছে না? কেন স্পাইডারম্যান এসে যাচ্ছে না? কেন তুলে নিয়ে যাচ্ছ না লোকটাকে? লোকটাকে তো কোথায় সে দেখেছে…হ্যাঁ হ্যাঁ টাকাতে। ছবিটা থাকে তো।

পুটু জানে না কখন তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে গাল বেয়ে নামছে। কখন পাশে এসে বসেছে হাসিদিদি। তার কাঁধটা জড়িয়ে বসেছে। হাসিদিদি রঞ্জিতাদের আত্মীয় হয়। প্রায়ই আসে। আর আজ তো ছুটির দিন।

পুটু বলল, ওকে কেন মারছে? ও কেন চলে যাচ্ছে না? ও কেন পালাচ্ছে না?

পুটুর গলাটা জড়িয়ে এলো। হাসিদিদি বলল, ওর স্কুলে একবার ইনস্পেকটর এসেছিল। সবাইকে কেটলি বানান লিখতে বলেছিল। ও ভুল বানান লিখছিল। সামনের ছেলেটা ঠিক বানান লিখছিল। স্যার এসে চোখের ইশারায় বারবার বলে বানানটা ঠিক করে নিতে সামনের ছেলেটার দেখে, কিন্তু ও করেনি। কারণ ও যেটা ঠিক সেটাই করবে। এখানেও তাই।

পুটু বলল, বাবা পরশু আসছে… আমার খুব ভয় করছে….

হাসিদিদি বলল, তুই এই লোকটার মত সাহসী হবি। তুই মাকে মারার সময় ঘর ছাড়বি না। তোকে মারলেও ঘর থেকে যাবি না। বাবার সঙ্গে গায়ের জোরে পারবি না। মায়ের ফোনটা নিয়ে সোজা থানায় ফোন করবি। আমি নাম্বারটা দিচ্ছি, তুই সেভ করে নে।

 

======

 

হাসিদিদি সাইকেলটা নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে চালিয়ে এলো। পুটু দেখছে জানলায় দাঁড়িয়ে। তার হাত পা এখনও কাঁপছে। একটু আগে পুলিশ এসে বাবাকে নিয়ে গেছে। মাকে নিয়ে সেও যাবে থানায়। ঠাকুমাও যাবে। ঠাকুর্দা পারবে না বলছে। ঠাকুর্দা বলছে, বাবার চাকরি যাবে। কি খাবি রে শালা?

পুটু উত্তর দেয়নি। আর কিছু খাক না খাক, মার তো খেতে হবে না। পুটু একটা জিনিস বুঝতে পেরেছে মারের থেকেও সাহসটা বড়। সেদিন টিভিতে লোকটাকে মারছিল, কিন্তু ওর সাহসটা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল পুটু।

তার ব্যাগে একটা স্পাইডারম্যানের ছবি থাকত। মা মার খেলেই সে পাগলের মত স্পাইডারম্যানকে ডাকত। আজ থেকে ডাকবে না। আজ থেকে সে সাহসী হবে। সহ্য করবে, কিন্তু নড়বে না। মারলেও না। যতক্ষণ না পুলিশ আসে। তার মারার জোর না থাকুক, আটকানোর সাহস আছে এখন। পুলিশকে ডাকার সাহস তো আছে।

 

=======

 

পুটু মাকে নিয়ে টোটোতে উঠল। মা চুপ করে আছে। পাড়ার সবাই রাস্তায়। দেখছে। কেউ কেউ এগিয়ে এসে বলছে, ঠিক করেছ…অ্যাদ্দিন করোনি কেন? আমরা তো তাই ভাবতাম!

পুটুর সঙ্গে এতক্ষণ মা কোনো কথা বলেনি। এইবার পুটুর মাথায় হাত দিয়ে মা জিজ্ঞাসা করল, ব্যথা করছে তোর?

পুটুর চোখটা, গলাটা, নাকটা টাটিয়ে এলো। কিন্তু কাঁদবে না সে। সে মাথাটা ঝাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়েই বলল, না না।

কিন্তু এখনও থাইটা, পিঠটা টনটন করছে। বাবা লাথিও মেরেছে তাকে আজকে, থাইতে। তবু নড়েনি সে। বাবাকে ঘরে আটকে সত্যি সত্যিই থানায় ফোন করে দিয়েছে। একটুও ভয় পায়নি।

মা পুটুকে তার দিকে টেনে নিল। ঠাকুমা টোটোতে উল্টো দিকে বসে। বলল, আজ এত সাহস কোদ্দিয়ে এলো রে তোর?

পুটু চুপ করে থাকল।