এখন চেপে রাখা যায় না, মনে হচ্ছে বিন্দু বিন্দু লুঙ্গিটা ভিজছে হিসিতে। ভাদ্রের প্যাচপেচে গরম আরো অসহ্য লাগছে। হাতে শক্ত করে ধরা মুড়ির ঠোঙা। বুকের কাছে। ডান হাতটা দিয়ে। বাঁ হাতটা অসাড় প্রায়। ওঠে না।
বাড়ি গিয়ে একটা বাটিতে অল্প কিছুটা মুড়ি ঢেলে শোয়ার ঘরে ঢুকল। ষোলো বছর, আটমাসের রুগ্ন একটা ছেলে। দুটো হাত, দুটো পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। তার দিকে তাকিয়ে আছে। ফুঁসছে। চোখের কোল গড়িয়ে নামছে জল।
তার নাতি। বাপ মা মরা। মানসিক ভারসাম্যহীন। অনেকেই বলে হোমে দিয়ে দিতে। দিতে মন চায় না। নেশা লাগে ওকে দেখলে। বাঁচতে ইচ্ছা করে। ও চলে গেলে একদিনও বাঁচতে ইচ্ছা করবে না। এক ঘন্টাও না।
বয়স্ক মানুষটা মুড়ির বাটিটা খাটে রেখে, নিজের চশমাটা খুলে পাশের টেবিলে রেখে, নাতির হাতের দড়িটা খুলে দিল। সে উঠেই ঠাস ঠাস করে দাদুর গালে চড় বসিয়ে যেতে লাগল। বৃদ্ধের মুখ নির্বিকার। মনের মধ্যে একটা শান্তি। তৃপ্তি। অনেক পাপ জীবনে। অনেক পাপ। কাউকে শান্তি দিতে পারেনি। না স্ত্রীকে। না মেয়েকে। না নিজেকে। স্বভাব দোষের পাপ। এ মার তার প্রায়শ্চিত্ত।
নাতি মুড়ি চিবাচ্ছে। লালা খালি গা বেয়ে গড়িয়ে নামছে। শুকিয়ে যাচ্ছে। সারা গায়ে মাস দশেকের ময়লা। স্নান করাবে কে? আগে পারত বৃদ্ধ, এখন পারে না। ছেলেটার চুলে জট পাকিয়ে জঙ্গল। তবে দাড়িগোঁফ হয়নি, ওর বাবার মত।
=======
রাত দুটো। কুকুরের ডাকে ঘুম ভাঙল বৃদ্ধের। চেয়ারে বসা। পাশে নাতি ঘুমাচ্ছে, না জেগে? জানলা দিয়ে আসছে রাস্তার আলো। সেদিকে তাকিয়ে?
কাছে গেল। কুকুরের মত গোঁ গোঁ আওয়াজ করল নাতি। তবে তো জেগে আছে।
বৃদ্ধ মেঝেতে শুয়ে। খানিকবাদে পিঠে ঠেকছে গরম জল। হিসি করছে নাতি। ইচ্ছা করে। পায়খানা পেলে প্লাস্টিকে করে। কোমরের নীচে জমে। হিসি গড়িয়ে সারা ঘর হয়। জল দেয় না রাতে। তবু এত জল পেটে জন্মায় কি করে?
======
সকাল হল। বেলা দশটা। নাতি উলঙ্গ শুয়ে খাটে। সব কাচাকাচি করতে দাদু টাইমকলের নীচে। প্রচুর নোংরা লেগে সব কিছুতে। আমিষ দেয় না। তাই পায়খানায় আমিষ গন্ধ নেই। দুবেলা শুধু মুড়ি।
হঠাৎ খটাং করে আওয়াজ এলো ঘর থেকে। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল। তবে কি দড়ি বাঁধাটা হয়নি? ভুলে গেছে?
প্রত্যয় এগিয়ে আসছে, হাতে লোহার রড। ওটা আসলে জানলার রড ছিল। জং ধরা নীচেটা। সূচালো। প্রত্যয় উলঙ্গ। হাসছে। পাগল শালা! হাসছে দেখো!
খোকন বিশ্বাস উঠে দাঁড়ালো। সারাটা শরীর কাঁপছে। তিয়াত্তরটা বছর…. সামনে দাঁড়িয়ে। শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। কিচ্ছু জমেনি। যে কাঠের পাটাতনটা দিয়ে কাপড় কাচছিল পিটিয়ে পিটিয়ে, একটা হাতে, সেটা শক্ত করে ধরে বলল, আর এক পাও এগোবি না প্রত্যয়… খুন হয়ে যাবি…..
প্রত্যয় হাসছে। হো হো করে হাসছে। তার সব পাপের খবর কি করে যেন জানে প্রত্যয়। সব জানে। এই প্রত্যয়…. থাম… থাম…..
কাঠের পাটাতনটা ছুঁড়ে মারল খোকন বিশ্বাস প্রত্যয়ের মাথা টিপ করে। ঝাঁটার কাঠির মত প্রত্যয় পড়ল মাটিতে। গল গল করে রক্ত বেরোচ্ছে। হেলে সাপের মত গড়িয়ে যাচ্ছে রক্তের স্রোত উঠান বেয়ে। মুড়িতে কত রক্ত হয়?
খোকন বিশ্বাস সব কাচা সম্পূর্ণ করল। তারে মেলে ক্লিপ লাগালো সব কটাতে। আজকে আকাশে মেঘ। বৃষ্টি হবে। পূর্বাভাস আছে।
ঘর গুছিয়ে প্রত্যয়ের সামনে এসে ঝুঁকে বসল খোকন বিশ্বাস। নাকের কাছে আঙুল নিল। নেই। শেষ।
খোকন বিশ্বাস দরজায় তালা লাগিয়ে রাস্তায় বেরোলো। পরনে নীল চেক চেক লুঙ্গিটা আর গায়ে সবুজ ফতুয়া। বিন্দু বিন্দু হিসিতে লুঙ্গি ভিজে যাচ্ছে। কব্জিতে বাঁধা আশি টাকার ডিজিটাল ঘড়ি। এগারোটা পঞ্চান্ন। একটু বাদেই বারোটা দশের শিয়ালদা লোকাল সেতুটা পেরোবে। ঝমঝম আওয়াজ হবে। কানে তালা লেগে যায় যাত্রীদের।
খোকন বিশ্বাস লাইনে দাঁড়িয়ে। শুদ্ধ মানুষের জীবন। ভীষণ পবিত্র। শ্রমের বিনিময়ে জীবনযাপন করবে শত বছর, ঋষিবাক্য। খোকন বিশ্বাস মানুষ নয়, পাপী। কাউকে শান্তি দেয়নি। নিজেকেও না। মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু পাপ নয়। জানত খোকন বিশ্বাস। ভাবেনি কোনোদিন। আজও ভাবে না। শুধু জানে, অন্যরকম হতেও পারত। এই জানাটাই পাপ। জ্বালা।
ব্রীজটা কাঁপছে। ভীষণ জোর। সে আসছে।
খোকন বিশ্বাস বৃষ্টিতে ভিজছিল। জানত আজ ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে। শুধু সে খেয়াল করেনি যে সে ডাউন না, আপের লাইনে দাঁড়িয়েছিল। ট্রেন এসেছিল পেছন থেকে। অসতর্কতায়।