সমস্যাটা হল একটা দিয়ে সবটা ব্যাখ্যা করা যায় না। যে রাজনীতি বোঝে, সে ভাবে রাজনীতি দিয়ে সবটা ব্যাখ্যা করবে। যে যৌনতা বোঝে সে ভাবে যৌনতা দিয়ে ব্যাখ্যা করাই বুঝি সবটা ব্যাখ্যা করা গেল। তেমনই যে ভক্তিপ্রাণ সে ভক্তি দিয়ে সবটা ব্যাখ্যা করে ফেলতে চায়। কেউ দর্শন, কেউ অর্থনীতি, কেউ কোনো শ্রেণীর শোষণের কথা আর শোষিতের কথা ইত্যাদি দিয়ে সবটার সমীকরণ টানতে চায়। তা হয় কি?
আসলে মানুষকে, একটা সময়কে গোটাগুটি কখনওই ব্যাখ্যা করা যায় না। তার বড় একটা কারণ শব্দের সীমাবদ্ধতা আছে। ভাবের, বোধের বৈচিত্র্যতা আছে। সব বুঝি বললে তো বিপদ।
কোনো মানুষই একমাত্রিক নয়। কোনো সমাজ, কি সভ্যতা, কি কোনো সময়ই একমাত্রিক তো নয়, তবে? বহুমাত্রিকভাবে বিশ্লেষণ একজনের পক্ষে সম্ভব কিছুতেই নয়। সে একদিকে ঝোল গড়াবেই গড়াবে।
এই রকম অবস্থায় বাঁচার উপায় কি? প্রশ্ন করতে শেখা। যাকে বলে ফাণ্ডামেন্টাল প্রশ্ন, সেই প্রশ্নগুলো করতে শেখা। যেটা জানি, সেটাকে স্পষ্ট বুঝতে যা জানি না সেটার দিকে দাঁড়াতে হয়। প্রশ্ন ভক্তি, বিদ্বেষ, প্ররোচনা, মতলব মুক্ত হতে হয়। ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত লাভক্ষতির, রুচি-পছন্দের বাইরে হতে হয়। সমস্ত আবেগবর্জিত হতে হয়। এবং সর্বোপরি সরল হতে হয়। প্রশ্ন জটিল অর্থ আমি প্রশ্নটাই বুঝিনি। পৃথিবীতে সমস্ত জ্ঞানের দরজা সরল প্রশ্নের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। হবেও। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম্বার ভিত্তিক প্রশ্নে কেরিয়ার গড়া যায়, সত্যের অন্বেষণ করা যায় না। যে প্রশ্ন যত সৎ, যত পক্ষপাতশূন্য, যত তীক্ষ্ম, যত নৈর্ব্যক্তিক, তত সে সত্যের কাছাকাছি।
মানুষকে বাঁচিয়েছে প্রশ্নের যন্ত্রণা। প্রশ্নের আকুলতা। মানুষকে বেঁধেছে উত্তরের কারাগার। ব্যাখ্যার দ্বীপপুঞ্জ। প্রশ্নের আকুতিতে সত্য ধরা দেয়। সৎ প্রশ্নের প্রাণশক্তি তার ধৈর্য্যতে। প্রশ্নেই চেতনা জাগে। প্রশ্নেই সত্য নিজেকে উন্মুক্ত করে। শুধু প্রশ্নে যেন প্রশ্ন আর প্রশ্নকর্তা সৎ হয়। তবে ভয় নেই। আমাদের কেউ আটকাতে পারবে না। কেউ ভুল বুঝিয়ে বেশিদিন ভুলিয়েও রাখতে পারবে না। এগিয়ে পড়ো, এগিয়ে পড়ো, যে কথা ধ্বনিত হচ্ছে যুগযুগান্তর ধরে সভ্যতায় সভ্যতায় সে প্রশ্নের হাত ধরেই এগিয়েছে। জাগ্রত বিবেকের প্রশ্ন। জাগ্রত চেতনার প্রশ্ন। উত্তর আর ব্যাখ্যা তো পিঞ্জর। দুর্বলের সাময়িক আত্মতোষণ। প্রশ্ন শুধু আরো গভীরের প্রশ্নকে জাগিয়ে দেয়। সে প্রশ্ন আরো গভীরে নিয়ে যায়। শান্তি? শান্তি উত্তরে নয়। শান্তি এই প্রশ্নের স্রোতকেই সত্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ উপলব্ধি করায়। তখন প্রশ্ন হারিয়ে তৃষ্ণা জন্মায়। যে তৃষ্ণা কোনোদিন মিটবে না বলেই স্বস্তি। দার্শনিক থেকে বিজ্ঞানী তা-ই চির অতৃপ্ত। আর সেই অতৃপ্তিই তার ধী - এর গৌরব। আলোকময় ধ্বজা। মানুষের অগ্রসর হওয়ার এই একমাত্র উপায়। কোনো প্রতিষ্ঠান, সে যে প্রতিষ্ঠানই হোক, এই প্রশ্নের অধিকার থেকে আমাদের যেন বঞ্চিত না করে। কোনো উপঢৌকন, পদ, মর্যাদা, শিরোপায়, শংসাপত্রে যেন না ভোলায় আমাদের। কোনো স্বর্গ, দেবতা, মন্ত্রতন্ত্র যেন রাস্তা আটকে না দাঁড়ায়। প্রশ্নহীন হলে সত্যহীন হব। সত্যহীন হলে বিলীন হয়ে যাব। আজ না হয় কাল, শুধু সময়ের অপেক্ষা।
প্রথম প্রশ্ন নিজেকে। আমার প্রশ্নগুলো কি সৎ? ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ নিরপেক্ষ? এই শুরু। শেষ নেই।