Skip to main content

একটা দোয়েল সকাল হলেই জানলার বাইরে পাঁচিলে এসে বসে। ডাকে। হাঁটে। উড়ে যায়। আমার ঘরেও অনেক মানুষ এসে বসে। কথা বলে। কথা শোনে। চলে যায়।

       মানুষ পাখি নয়। কিন্তু অনেক গানে কবিতায় মানুষ পাখি হতে চেয়েছে। উড়ে যেতে চেয়েছে। মাটি যেন বাঁধন। আকাশ যেন মুক্তি। মানুষ আর পাখি দুজনেই বাতাসের সমুদ্রে বাঁচে। পাখি সমুদ্রের উপরিতলে উড়ে বেড়ায়, যেমন মাছেরা জলে ভেসে বেড়ায়, মানুষ বাতাসের সমুদ্রের তলদেশে হামাগুড়ি দিয়ে, হেঁটে চলে। মানুষ আর সব পাখির মধ্যে একটা গভীর পার্থক্য হল মানুষ পাখি হতে চায়, পাখি কিচ্ছু চায় না।

       মানুষ চায়। পাখি চায় না। পাখি ওড়ে, বাসা বাঁধে, ডাকে, প্রজনন করে – এগুলো তার চাওয়া নয়, এগুলো তার প্রকৃতি। মানুষ চায়। মানুষের চাওয়াটা পাখির মত তার বুকের মধ্যে বাসা করে। কানে শোনা, চোখে দেখা, কল্পনা করা – এ সব কুড়িয়ে বাসা বানায় বুকে। তারপর আশা ফুটে চাওয়ার পাখি জন্মায়। আশা কোথা থেকে জন্মায়? মানুষের জন্মলগ্ন থেকেই আশার বীজ তার মধ্যে। সব আশা চাওয়ায় অঙ্কুরিত হয় না। সব আশাকে মানুষ জানেও না। ধাক্কা খেলে, তেষ্টা পেলে, আবছা আলোয় মাঝপথে ঘুম পেলে মানুষ বুকের মধ্যে আশা হাতড়ায়। আশারা স্বপ্নের মধ্যে মঞ্চ তৈরি করে। অভিনয় করে। মানুষ ঘুমের মধ্যে অন্য মানুষ হয়ে যায়। এক একটা মানুষ রক্তবীজ। এক মানুষের অনেক মানুষ। যেন সন্ধ্যেবেলা ঘরে ফেরা শয়ে শয়ে পাখি। ওরা মানুষ বৃক্ষতে বাসা বেঁধে আছে।

       আশা ফুটে চাওয়া জন্মালো। চিঁচিঁ ডাকে মানুষকে বলল, ওঠো। মানুষ জানলো না কখন তার বুকে সে জন্মালো। চাওয়া আকাশ চাইল, খাদ্য চাইল, সুরক্ষা চাইল। মানুষ দৌড়ালো। মানুষ ছুটল। চাওয়া ডানা ঝাপটালো।

       সব পাখি খাদ্য পেল না, আকাশ পেল না, সুরক্ষা পেল না। দিনের শেষে অনেক পাখি মৃত। তাদের পালকের গায়ে গায়ে ব্যর্থতা। মানুষ বলল, আমি ব্যর্থ হলাম। হাতে গোনা কয়েকটা পাখি উড়ে আকাশে গেল। তারাও পর হল। চাওয়া তৃপ্ত হলে পাখি পর হয়ে যায়। উড়ে যায়। চাওয়ার তৃপ্তি মানুষ পায় ক্ষণিকের জন্য, একটা ডানার ঝাপট যেন। তারপর শূন্য নীড়।

       মৃত পাখির শাবক আর উড়ে যাওয়া পাখির হিসাব রাখতে রাখতে মানুষ বৃদ্ধ হয়। হতাশার ঝুরি নামে বৃক্ষের গা থেকে। ওরা মাটি চায়, আকাশ চায় না। মাটি চাওয়া ঝুরি আর আকাশ চাওয়া পাখির কথা শোনে মানুষ। মানুষ নিজেকে প্রশ্ন করে - সে মাটির, না আকাশের?

       সমস্ত ঝুরি মাটি পায় না। তারা অলীক ঝুরি। অলীক হতাশা। মানুষ ত্রিশঙ্কুর মত দিগন্তরেখায় ঈশ্বরকে খোঁজে। তার চোখেমুখে বাতাস খেলে যায়। বাতাসের শীতলতায় ঈশ্বরের গল্প। অনঙ্কুরিত আশাদের সেই বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে মানুষ মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করে। মৃত পাখি, উড়ে যাওয়া পাখিদের কথা মনে পড়ে। সবটাই যেন খেলা; খেলার নাম - প্রবঞ্চনা। গোটা বিশ্বকে ক্ষমা করতে করতে, গোটা জীবনের আঁশ ছাড়িয়ে একা হতে হতে মৃত্যুকে বলে, আমি একটা গভীর ডুব দেব, সমস্ত শ্বাস বন্ধ করে দাও। মানুষ মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে দেখে কোনো পাখি উড়ে মৃত্যুর কাঁধে বসেছে কিনা। তার চেনা কোনো পাখি, যারা উড়ে গিয়েছিল। কেউ তার মৃত্যুর সাক্ষী হয় না। মানুষ সব শ্বাস সমুদ্রের পাড়ে রেখে একা স্নানে নামে। আর ওঠে না। মাটিতে তখন অন্য একটা চারা জন্মাচ্ছে, বৃক্ষ হতে পারে যে, আবার নাও হতে পারে। তার মাথার উপর পাখিদের চক্রব্যূহ, বুকের ভিতর আশার বালি চিকচিক করছে।