Skip to main content

সবাই যে ধর্তব্যের মধ্যে ধরবে তা তো নয়। না তো কি সবাইকে আমিও ধর্তব্যের মধ্যে ধরব।

    কোনো মানুষকে যখন জানি, তখন শুধুই তাকে জানি। যখন তাকে ভালোবাসি তখনই সে মানুষটা সত্য হয় আমার কাছে। আমার ধর্তব্যের মধ্যে আসে।

    নইলে এই যে পোলাও আর আলুরদম খাওয়াচ্ছে, কেউ তো বলছে না, ও ঠাকুমা তুমি উঠে যাও, তোমার তো অন্য ধর্ম। কেউ তো বলছে না!

    এই পাড়ায় কেউ বড়লোক নয়। আবার সবাই ছোটোলোকও নয়। হৃদয় আছে অনেকের। হৃদয় আছে বলেই এই খাবারই অমৃত।

    বৃদ্ধা, এখন নাম শুধুই ঠাকুমা, দুর্গার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খাচ্ছে, আর মনে মনে হাসছে। টেবিল চেয়ার নড়বড়ে। কাদা মাটি তো। বৃষ্টি হয়ে গেছে না বিকেলে। হাসছে কেন? খালি মনে হচ্ছে, মানুষের পেট এক, খিদে এক, খিদের জ্বালা এক, ভালোবাসায় কাঁদলে বুকে ব্যথাও এক, তবু নাকি ভিন্ন মানুষ। দুটো দেশই আলাদা হয়ে গেল। কি আশ্চর্য লাগে ভাবলে।

    তুমি এদেশে কেন?

    কেউ জিজ্ঞাসা করে না। এ পাড়ায় তো কত জন্ম বাস তার। এখন লোকে বলে বাঙাল কলোনি। কিন্তু তখন তো ছিল ভাগাড়।

    কেউ চাঁদা চায় না। কিন্তু শরীর খারাপ থাকলে পুজোগণ্ডার দিন পাড়ার ছেলেগুলো খাবারও পৌঁছে দেয় ঘরে গিয়ে। কদিন না বেরোলে খোঁজ নেয়। চা খেতে ডাকে বিকেলে এ বাড়ি, ও বাড়ি। করোনার সময় বাইকে করে ভ্যাচকিন না কি বলে, সেও দেওয়াতে নিয়ে গিয়েছিল। তবে? ভিন্নটা কোথায়? ভালোবাসলে মানুষ সত্য হয়, এই আসল কথা।

    ঠাকুমা আলুরদম দেব?

    না চাইতেও দিল। একজন বলল, খেয়ে নাও, কোনদিন টুস্‌ করে চলে যাবে। আমরাই তো তোমার নামে শ্রাদ্ধ করব…

    একজন পাশ থেকে বলল, শ্রাদ্ধ… কিরে তুই?

    সে জিভ কেটে বলল, ও ঠাকুমা সরি সরি… আমার মনে ছিল না…

    ঠাকুমা হেসে বললেন, আমি ঠাকুমা… আর কি মনে রাখবি? শরীর ঠাণ্ডা হলে সব সমান…..

    ঠাকুমার খাওয়া হল। একজন মগে করে জল দিতে দিতে বলল, এই যে লোকে এত ধর্ম নিয়ে গোল করে শুনি আজকাল… তোমার কি মনে হয়?

    ঠাকুমা বলল, মানুষের মধ্যে বারুদ পুরলে যাদের সুবিধা তারাই ও কাজ করে… মানুষে মানুষে বাগান বানাতে পারো? তার জন্যে যে অনেক খাটনি… এক এক গাছ, এক এক মাটি…. তার যত্ন… কে করবে? কিন্তু বারুদের গন্ধ তো সব দিকেই সমান…. সুযোগ বুঝে আগুন জ্বালিয়ে দাও….

    ছেলেটা বলল, হুম।

    ঠাকুমা ঘরে এসে বসল। পাড়ার একটা ছেলেই এগিয়ে দিয়ে গেল। ঘুম আসছে না। কাল বিসর্জন আছে। আজ অনেক রাত অবধি ওরা নাচবে, গাইবে। করুক, আনন্দ করুক। কদিন বাদেই তো আবার হাড়ভাঙা খাটুনি। কেউ কলের কাজ করে, কেউ টোটো চালায়, কেউ বিড়ি বাঁধে তার মতন, ওতেই সংসার চলে যায়।

    ঠাকুমা শুলো। ঘুমালে কারোর কোনো জাত নেই, ধর্ম নেই। সব সমান। জাগলেই যত গোল। ঘরের আলো নেভালো। বাইরের চিকমিক আলো এসে ঘরে পড়ছে। মাইক চলছে। ওদের হুল্লোড়ের আওয়াজ আসছে। আনন্দের কোনো জাত নেই। আনন্দ বড় শুদ্ধ। বুকের মধ্যে জাগলে সব শান্ত।

    ঠাকুমা উঠল। ঘুম আসছে না। দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালো। ওরা নাচছে। ইচ্ছা করল যাই। কিন্তু থাক। ওদের বিব্রত করে লাভ নেই।

    হাঁটতে হাঁটতে এসে একটা বড় মাঠে দাঁড়ালো। চাঁদ উঠেছে। আধখানা। মেঘ অল্প অল্প। ভিজে মাটি। শিশিরে। পা রাখল। সারাটা গা দিয়ে পৃথিবী মিশে এলো শরীরে। ঠাকুমা জিজ্ঞাসা করল, পৃথিবী তোমার ধর্ম কি?

    পৃথিবী বুকটা জড়িয়ে, দুটো গালে দুটো চুমু খেয়ে বলল, অসীম সহ্য ক্ষমতা। ভালোবাসায়। ক্ষমায়।