সৌরভ ভট্টাচার্য
27 March 2020
প্রিয়,
এই শব্দটা কতদিন পর বিশ্বাস থেকে উচ্চারণ করলাম। আশা করি তুমি ভালো আছো? আমিও আছি। কয়েকটা কথা বলব বলে লিখতে বসা।
দেখো, যে দূরত্বটা তুমি আর আমি দু’জনেই মনে-প্রাণে চাইছিলাম, সেই দূরত্বটা চীনের দৌলতে আমরা কেমন হঠাৎ করে পেয়ে গেলাম। আমরা দূরত্বটা চাইছিলাম কারণ আমাদের সম্পর্কটাকে সুস্থ করার জন্য, সম্পর্কটার অন্দরমহলে উঁকি দিয়ে তার প্রাণভোমরাটা বেঁচে আছে কিনা দেখার জন্য।
তুমি জানো সে ভোমরা বেঁচে আছে। কষ্ট পাচ্ছে। তুমি-আমি দু’জনেই পাচ্ছি। আসলে কি জানো? সম্পর্ক মানে টানাপোড়েন। আমি বুঝতে পারছি। যে সম্পর্কে হৃদয় আছে প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে সেখানে টানাপোড়েন হবেই। যে সম্পর্কে প্রয়োজন থাকে হৃদয়ের ঊর্ধ্বে সেখানে টানাপোড়েন বড় বাইরের জিনিস। সে হিসাবের জিনিস, ক্ষোভের জিনিস নয়, অভিমানের জিনিস নয়। তুমি আমার আনন্দ, তাই বিষাদের কারণ যদি কেউ হয় সে একমাত্র তুমিই হতে পারো, তাই নয় কি? যে জলে মানুষ তৃপ্তি পায়, তেষ্টাও তো সেই জলের জন্যেই বুক টাটিয়ে ওঠে, তাই কিনা বলো? অথচ আমরা দু’জনেই ভেবেছি হয় তো আমরা দু’জনের কাছে দু’জনে ফুরিয়ে আসছি। কেন ভেবেছি?
এর কোনো উত্তর হয়তো আমার স্পষ্ট জানা নেই। সংসারের একঘেয়েমি হয়তো কিছুটা কারণ। যে একঘেয়েমিতে হৃদয়ের আবেদন খারিজ হয়ে প্রয়োজনের ফরমায়েশ মেটাতে মেটাতে আমরা হয় তো ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছিলাম। যেমন আমাদের চারপাশটা ক্ষয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। যেন আমরা যদুবংশের সেই সদস্যরা। আমরা জানি কোথায় বাঁশিটা বাজছে, আমরা জানি সে গাছের তলায় এসে দাঁড়ালে, সেই বংশীবাদকের কাছে এসে বসলে আমরা আবার আমাদের ছন্দে ফিরতে পারি। কিন্তু আমরা যাব না। যেতে গেলে যে অনেক কিছু ভাসিয়ে যেতে হবে! তাই যমুনা আমাদের কাপড় কাচার, স্নানে যাওয়ার, কলকারখানা গড়ার কাজের নদী হল, প্রেমের যমুনা হল না।
অথচ আজ দেখো, সব কাপড়কাচা, কলকারাখানা সব বন্ধ করে পিলসুজ আঁকড়ে বসে আছি, যেন শিখাটা নিভে না যায়, শিখাটা নিভে গেলে যে সব অন্ধকার! হায় রে ভাগ্য, এতদিন এই পিলসুজটাকেই অতিরিক্ত মনে হয়েছিল, যেন সবটুকু আবশ্যক, সেই শুধু বাড়তি।
এইভাবেই ক্ষয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। আমাদের সাথে প্রকৃতি। আজ এত মানুষের বলিদানে আমরা কিসের মূল্য চোকাচ্ছি জানি না। তবে সে ত্যাগ যদি আপনা থেকে হত তবে নিজেদের গৌরবটুকু থাকত, আজ এই বাধ্যতার সাথে সবটুকু ক্ষতি মাথা পেতে নিয়ে যেভাবে ঘরে দোর দিয়ে বসে আছি, এতে আমাদের না আছে গৌরব, না স্বস্তি।
জগতের কথা থাক, আমাদের সম্পর্কের কথায় আসি। আমরা আমাদের সম্পর্কের মাধুর্যকে হারিয়ে যে ক্ষীণ, দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম, একে অপরের কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিলাম তার একটা বড় কারণ, আমরা আমাদের মহত্ববোধটুকুকে হারাচ্ছিলাম। ভেবে দেখো? প্রতিদিন নিজের আচরণ, নিজেদের ঘাত-প্রতিঘাতে নিজেকে ছোটো করে ফেলছিলাম না? বিকার জমছিলো না মনের কোণায়? মানুষ নিজের মধ্যে মহত্বের অনুভব ছাড়া স্বপ্ন দেখতে পারে না। ক্ষুদ্র মানুষ বাসনার জাল বোনে, সে জালে নিজেই আটকে নিজেকে ব্যর্থ করে, বেঘোরে মরে। সে মৃত্যু লজ্জার। যে মানুষের মনে মহত্বের অনুভব, সে স্বপ্নের রাজ্য গড়ে, ভাবীকালের উপাদানে। সে স্বপ্নরাজ্য বাস্তবে না গড়ে উঠলেও, তার সাথে তার বাস্তবের একটা সঙ্গতি থাকে। সে পূর্ণ হতে না পারলেও ব্যর্থ হয় না।
তুমি যখন রাতের ট্রেনে ফিরতে, আজ বলতে লজ্জা নেই, আমি বাইকে বসে বসে তোমার মৃত্যুকামনা করতাম। তোমার হাত থেকে ছুটি চাইতাম। যেন তুমিই আমার জীবনটাকে কারাগারে আবদ্ধ করে রেখেছ। তুমিই কারাগার। তুমি যখন ট্রেন থেকে নেমে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে, আমি জানি সেটা মেকি। তুমিও জানতে, মুখোশ ওটা। আমিও হাসতাম, অবিশ্বাসের হাসি। তুমি বাইকে বসে আমার কাঁধে হাত রাখতে। আমার অসহ্য লাগত। তোমার পার্ফিউমের গন্ধে আমার গা গুলিয়ে যেত। এক-এক সময় মনে হত তোমায় গলা টিপে এই অন্ধকার রাস্তায় ফেলে রেখে যাই কোথাও।
যে দিন আমাদের শরীরের তাগিদে মিলতে হত, হয়ে যাওয়ার পর সারা গায়ে যেন গ্লানিতে কাদার মত ঘাঁটাঘাঁটি হয়ে যেত। তোমার গোটা শরীরটা একদলা মিথ্যা মনে হত। আমি মনে মনে অন্য শরীর কামনা করতাম। তোমায় মনে মনে লাঞ্ছিত করতাম। একটা পৈশাচিক সুখে ঘুম চলে আসত। পরেরদিন সকালে আবার একটা জীবন্ত লাশের মত বিছানা ছাড়তাম। আমৃত্যু উপার্জনের নেশা, তরল গরলের নেশা, লাগাম ছাড়া শরীর শিকারের নেশা, এবং সর্বোপরি আত্মহত্যার দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতাম। আগে আত্মহত্যার জায়গায় ভাবতাম পালাবো, শেষের দিকে মনে হত পৃথিবীতে পালানোর জায়গা নেই, বড় ছোটো একঘেয়ে গ্রহ একটা।
আজ যখন কাকের ডাকে ঘুম ভাঙছে, আজ যখন সব তাড়া মৃত, আজ তখন মনে হচ্ছে আমি যেন খোলস ত্যাগ করছি। আমার মধ্যের সেই প্রাচীন আমিটা আবার জেগে উঠছে যে শুধু তোমাকেই দেখে ভেবেছিল, এই সৌরজগতে একমাত্র আকাঙ্খা তার। কেন্দ্র তার। কিছু পাল্টায়নি জানো। আমরা কক্ষচ্যুত হয়েছিলাম। বাড়ি থেকে বেরোনো যাবে না আরো উনিশটা দিন হয় তো। কিন্তু আমি প্রতিদিন বাইক নিয়ে স্টেশানের ধারে দাঁড়াচ্ছি। একটা একটা ট্রেন আসছে, কত লোক নামছে, তুমি নামছ না। আমার কতদিন পর তোমায় হারিয়ে ফেলার ভয় হচ্ছে জানো? কতদিন পর! কতদিন পর মনে হচ্ছে তোমায় ছাড়া আমার মত মানুষের অস্তিত্ব কোথায়? আমি চলে যাওয়া ট্রেনগুলোর শেষ কামরার দপদপানি লাল আলো দেখতে দেখতে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে। সবটাই মনে মনে। তবু সবটাই সত্যি।
আজ মনে হয়, আচ্ছা যদি এই লকডাউন না হত? তবে কি সব ভেঙে চুরমার হত? না। একটা বড় বাজ পড়ত। যেটুকু মিথ্যা তা ভাঙত, দুর্বল বাড়ির ছাদের মত। হয় তো গোটা বাড়িটাই ভেঙে পড়ত। কিন্তু ভিতটা এক ইঞ্চি চিড় খেত না জানো? কেন বলো তো? সে বড্ড খাঁটি। সত্যতে চিড় ধরে না, গ্রহণ লাগে।
তুমি ফিরে এসো সব স্বাভাবিক হলে। আমরা টানাপোড়েনেই বাঁচব। সুখের উপসংহার যে টানতেই হবে তার কি মানে বলো?
ইতি
আমি
[ছবিঃ সুমন]