সৌরভ ভট্টাচার্য
10 February 2020
সকালে নিশ্চিন্তে প্রসন্ন মনে এক কাপ চা আর খবরের কাগজ নিয়ে বসে আছি। সকালের রোদ জানলা দিয়ে এসে আমার পিঠে, খাটের উপর বেশ আয়েস করে বসেছে। মনের মধ্যে এমন পরিপূর্ণতার বোধ যেন সেখানে বিন্দুমাত্র চিড় নেই, ফাঁক নেই, এমন একটা আত্মতৃপ্তির আমেজ।
ঘর মুছতে মুছতে হঠাৎ খাটের উপর রাখা পেনটার দিকে তাকিয়ে কাজের বউটা বলল, দাদা তুমি এই পেনটাই আমার মেয়েকে দিয়েছিলে না? অনেকদিন আগে আমার সাথে বিকালবেলায় একবার এসেছিল... মনে আছে তোমার? খুব কথা বলে...
আমার আবছা মনে পড়ল একটা বাচ্চার মুখ, কালো মতন, রোগা করে একটা বাচ্চা... জিজ্ঞাসা করলাম, কোন ক্লাসে পড়ে এখন সে?
ক্লাস টু-তে, ন্যাতাটা মাটিতে বোলাতে বোলাতে মাথা না তুলেই বলল।
আমার মনে পড়ে গেল, আমি তখন ক্লাস করাচ্ছিলাম, সে আমার ক্লাসরুমে ঢুকে এটা ওটা প্রশ্ন করে বেশ উত্যক্তই করে তুলেছিল। আমি হেসে আবার কাগজে মন দিলাম, এখন অযথা কথা বলে মনের এই শান্ত তৃপ্ত আমেজটার না চ্যুতি ঘটানোই ভালো।
সে আবার বলল, সেদিন কি হয়েছে জানো দাদা, ওর বাবাকে ও বলেছে একটা পেন্সিল কিনে এনে দিতে, ওর আঁকার ক্লাসে লাগবে। ওর বাবা ধুম করে রেগে গিয়ে বলল, এই ক্লাস টু-তেই যদি তোর এত পেন-খাতা লাগবে তো উঁচু ক্লাসে উঠলে তো আমায় ভিখারি করে ছাড়বি! মেয়ের তো মুখ কাঁদোকাঁদো দাদা, সে বলল, তোমার চেয়ে আমার জেঠু অনেক ভালো... সে আমায় না চাইতেও কত ভালোবেসে পেন দিয়েছে জানো, আঁকার খাতা দিয়েছে...
ওর বাবা তো বুঝতে পারছে না কে জেঠু.... আমি বললাম তোমার কথা দাদা..
আমি 'হাঁ' করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে, সে ঘর মুছে আমার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, আমার সত্যিই এখনও মনে পড়ছে না আমি তাকে পেন-খাতা দিয়েছি বলে... তবে সে যেভাবে বলছে তাতে অবিশ্বাস করার কোনো কারণও দেখছি না.... সে বলে চলল....
জানো দাদা, ওই পেন ও কাউকে ধরতে দেয় না, স্কুলে নিয়ে যায়, কোনো বন্ধুকে হাত দিতে দেয় না। আমি বলি, তোর জেঠুর দেওয়া পেন যদি এতই দামী তবে স্কুলে গিয়ে হারাবি নাকি? বাড়িতেই রেখে যা... তো সে প্রাণে ধরে তা-ও রাখবে না, যদি আমরা লিখে ফেলি... একবার আমার ননদের মেয়েরা এসেছে, তো বড় মেয়েটা ওই পেনটা নিয়ে যেই লিখতে বসেছে ও তাড়াতাড়ি গিয়ে বলল, ওরে এই পেনটা নিস নে রে... জেঠু দিয়েছে... অন্য পেন দিচ্ছি দাঁড়া... বলে অন্য একটা পেন ব্যাগ থেকে বার করে দিল....
আমার প্রসন্ন মন তখন কোথায়? চা ঠাণ্ডা হচ্ছে। আমি বক্তার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই দিনের স্মৃতিকে প্রাণপণে হাতড়ে বেড়াচ্ছি মাথার মধ্যে, বুকের মধ্যে। তার জন্য সেই স্নেহ-ভালোবাসার ছোঁয়াকে ছুঁতে চাইছি... কিচ্ছু পাচ্ছি না... কুণ্ঠায় নিজের মধ্যেই নিজে কুঁকড়ে যাচ্ছি.... আমি? সত্যিই সে আমি ছিলাম... হয় তো বা? সত্যিই কি অতটাই ভালোবেসে দিয়েছিলাম... নাকি নিছক সৌজন্য ছিল... একটা বাচ্চাকে কিছু দিতে ইচ্ছা করেছিল বলে দিয়েছিলাম নিতান্তই আত্মতৃপ্তির জন্য.... জানি না... যদি সত্যিই সেই ভালোবাসাই দিয়েছিলাম তবে তার মুখটা স্পষ্ট মনে নেই কেন আমার?....
সত্যিই গো দাদা... প্রায়ই তোমার কথা বলে জানো....
আমার কাছে এখনও প্রচুর পেন জমা বইয়ের আলমারিতে। এক মুহূর্ত মনে হল, দিই আরো কয়েকটা পেন বের করে ওর হাতে, ও দিক গিয়ে ওর মেয়েকে... পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম এ চিন্তার পিছনেও কত নীচ অহংকার আমার, আমার প্রচুর আছে তাই তাকে একটা দিলেই হয়... যে ভালোবাসা, যে গুরুত্ব, যে মান বিনা আয়াসে এসে পড়েছে তাকে আরো কায়েমি করার চেষ্টা, একি সত্যই আন্তরিক? ফাঁকি নয়? নিজেকে খুব ছোটো লাগল নিজের কাছে, খুব অকিঞ্চিৎকর। মনে মনে নত হলাম সেই শিশুটার কাছে যে আমার নিতান্ত সৌজন্যকে এমন ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায় বুকে আগলে রেখেছে। কাকে? না যে তাকে ভুলেই গেছে তার তথাকথিত প্রাচুর্যের অন্ধকারে। সমাজের তথাকথিত উঁচুস্থানে বসে নীচুর দিকে তাকাতে ভুলে যাওয়া মানুষটার কথা ভাবতে, যে খুব আবদারে তার ঘরে একদিন এসেছিল। তার সারল্যের কাছে অপরাধী হলাম।
আমি বললাম, একদিন এনো ওকে সময় করে....
সে "আচ্ছা" বলে অন্য ঘর মুছতে চলে গেল। আমার সামনে ঠাণ্ডা জল হয়ে যাওয়া চা.... আর আমাকে নিয়ে অপ্রস্তুত, হেঁট মাথা "আমি", প্রায়শ্চিত্তের অপেক্ষায়। ও আসুক সময় করে।