Skip to main content
প্রতীক্ষা

তোমার কোনো বাস্তব বোধ নেই।"
ঝিলিক কথাটা বলে ঝাঁট দিতে দিতে আড়চোখে একবার শুভায়ুকে দেখে নিল। শুভায়ু খবরের কাগজে ডুবে। মাথাটা না তুলেই বলল, হুঁ।
"কাল মুন্নীর স্কুল থেকে চিঠি দিয়েছে, ওদের এবারের সামার ভ্যাকেশানের ডেটটা কি কারণে যেন এগিয়ে এসেছে। রিজার্ভেশান করেছ?"
শুভায়ু চোখ তুলে বলল, বলোনি তো!
ঝিলিক ঝাঁঝিয়ে উঠল, বলিনি মানে? পরশু থেকে এই নিয়ে তিনবার বললাম।
"ও আচ্ছা, তাই!" শুভায়ু এবার ঘড়ির কাঁটাটার দিকে তাকাল। টিক্ টিক্ করে বেজে যাচ্ছে। কেন চলছে? শুভায়ুর আজকাল মাঝেমাঝেই সবকিছু ভীষণ অনর্থক, উদ্দেশ্যহীন লাগে। আর ভোলাটা তো একটা রোগে দাঁড়িয়ে গেছে। এই তো গত শনিবার, অফিসের পরিমলদা বারবার করে মনে করালো যেন এই সপ্তাহেই ব্যাঙ্কে গিয়ে লোনের ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলে। তার এই গড়িয়াহাটের ফ্ল্যাটের জন্য লোন নিয়েছিল। পরিমলদাই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তো সেটা শোধ হল এই গত জানুয়ারিতে। কি একটা সই করতে ম্যানেজার তাকে এই নিয়ে প্রায় ছ'সাতবার ফোন করেছেন। নেহাতই ভালমানুষ উনি আর পরিমলদার শালা বলে কিছু বলছেন না। নাহ্ কাজটা আর ঝুলিয়ে রাখা যাবে না।
শুভায়ু উঠে বেডরুমে গেল। জানলার পর্দাগুলো টেনে একটু শুল। রবিবারটায় কিছু করতেই ভাল লাগে না। আজকাল তো আরো লাগে না। এই উনচল্লিশেই সুগার, কোলেস্টেরল হাই। প্রেশার তো মাপায়ই না কদ্দিন হল। ধুস্! কি হবে ওসব করে।
ঝিলিক ঘরে ঢুকল, "শুলে যে! এই ভরদুপুরে কেউ শোয়? রাতে ঘুম আসবে? আবার মেয়েটাকে সারাটা রাত মেসেজ করে উত্ত্যক্ত করবে। তা এত পীরিত যখন, মেয়ে ছেড়ে থাকতেই পারো না যখন, কে বলেছিল দেরাদুনের অতদুরের স্কুলে পাঠাতে? আদিখ্যেতা দেখলে আমার হাড়পিত্তি জ্বলে যায়!"
তা ঠিক। শুভায়ুরই ইচ্ছা ছিল বেশি মুন্নীকে দেরাদুনের নামকরা স্কুলে পড়ানোর। আসলে শুভায়ুর মাসীর ছেলে রণিত পড়ত। ওর বাবা, মানে শুভায়ুর মেশো ছিলেন খুব বড় ইনকাম ট্যাক্স অফিসার। আর ওর নিজের বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক। একটা তীব্র ঈর্ষা কাজ করে শুভায়ুর মনে রণিতকে নিয়ে। সে এখন দুবাইতে থাকে। নামকরা ডাক্তার সেখানকার। প্রচুর টাকা। সেটা বড় কথা না অবশ্য, আসলে শুভায়ুরও অনেক পড়াশোনা করার ইচ্ছা ছিল। বাবা হঠাৎ স্ট্রোকে মারা গেলেন। ওদের বংশগত হার্টের রোগ। কেউই মোটামুটি ষাট পেরোননি। শুভায়ুর ভয় করে খুব মাঝে মাঝেই, সে চলে গেলে ঝিলিকের কি হবে? ঝিলিকের ঘুমন্ত মুখটার দিকে রাতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খুব কান্না পায়। অসহায় লাগে। ঠাকুরঘরে গিয়ে বসে আলো জ্বালিয়ে। মায়ের পাতা সিংহাসন। মা গেলেন বছর চারেক হল।
শুভায়ু দেখল, দশটা বাজে। নাহ্, কিছু খাবার আনতে হবে। আজকে আবার রান্নার দিদি আসবেন না। সামনের রেস্টুরেন্টে অবশ্য ফোন করলেই দিয়ে যায়। তবু থাক। একটু বেরোতে ইচ্ছা করছে হঠাৎ। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। আচ্ছা ওর কি কোনো নার্ভের রোগ হচ্ছে? সব ভুলে যাচ্ছে কেন?
"আমি একটু আসছি বুঝলে, দরজাটা আটকে দাও", বলতে বলতে সে পাঞ্জাবীটা গলিয়ে দরজার কাছ অবধি আসল। ঝিলিক এল, হঠাৎই ওর হাতদুটো ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, "তুমি দয়া করে রিজার্ভেশানটা করে ফিরো লক্ষীটি। গতবার এই করে মেয়েটাকে আনতে যাওয়া হয়নি মনে আছে? ও কত কষ্ট পেয়েছিল। এখনো ফোন করলে সেই কথা বলে। কাল কত রাত্রে আমায় ফোন করেছিল জানো? তুমি জানবে কি করে? ঘুমাচ্ছিলে তো! মেয়েটা কাঁদছে আর বলছে, মা, বাবা যেন এবার না ভুল যায় দেখো, প্লিজ..."
শুভায়ুর চোখটা ছলছল করে উঠল। কোনোরকমে ঝিলিকের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। ইচ্ছা করেই যেন চটিটার আওয়াজটা বেশি করে করল, ফট ফট ফট.....

ঘটনাটা সত্যিই। আট বছর আগের ঘটনা। মুন্নী ফোরে পড়ে। ওই দেরাদুনের স্কুলেই। সেবার গরমের ছুটিতে রিজার্ভেশান পায়নি। মানে যে ট্রাভেল এজেন্টকে দিয়ে রিজার্ভেশান করায়, তার মা হঠাৎ মারা যাওয়াতে সে আচমকাই সব ফেলে চলে যায়। এদিকে সিটও বেশি ছিল না। শুভায়ুকে জানিয়েও যায়নি। শনিবার সেই ট্রাভেল এজেন্টের দোকানে এসে দেখে তালা। তখন সব ওয়েটিং লিস্টে চলে গেছে। ঝিলিক আর মায়েরও যাওয়ার কথা ছিল। তারপর ফ্লাইটে আনতে গিয়েছিল সবাই। কিন্তু আনা আর হল না। কি একটা জ্বরে মুন্নী দেরদুনের হাসপাতালেই চলে গেল। ডাক্তার পরে বলেছিলেন একটা রেয়ার ভাইরাল ইনফেশান।
শুভায়ু ডাক্তার গাঙ্গুলীর বাড়ির দরজার কাছে এসে গেছে। দরজা খুলতেই শুভায়ু বলল, কাকু ঝিলিক কাল থেকে আবার খুব হাইপার।
ডাক্তার গাঙ্গুলী, খুব বড় নিউরো সাইকিয়াট্রিস্ট। ঝিলিকের দুঃসম্পর্কের কাকা। উনি বললেন, তুমি এগোও আমি আসছি।

 


(ছবিঃ সুমন)