সৌরভ ভট্টাচার্য
10 March 2018
ছেলেটা চুপ করে রাস্তার একটা ধারে দাঁড়িয়েছিল। সে দূরে দেখছে একটা বুড়ি গাছের তলায় বসে ঝিমোচ্ছে। ছেলেটা ডানদিক বাঁদিক একবার দেখল, তারপর ছুটে গিয়ে বুড়িটাকে একটা লাথি মারলো। বুড়িটা হুড়মুড় করে রাস্তার ধারে গড়িয়ে পড়ল। ছেলেটা খুব মন দিয়ে দেখতে লাগলো। মাথা থেকে পা অবধি কোথাও লেগেছে কি? হঠাৎ কি হলো ছেলেটা প্রচণ্ড চিৎকার করে হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে শুরু করলো। ততক্ষণে বুড়িটা উঠে বসেছে। ভয়ার্ত চোখে সে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ ছেলেটা কান্না থামিয়ে একটা ছোট ঢিলের টুকরো নিয়ে ছুঁড়ে মারল বুড়িটার মাথা তাক্ করে। বুড়িটা মাথা সরিয়ে নিলো। ফসকে গেল ঢিলটা। ছেলেটা হাততালি দিয়ে হেসে উঠলো। বুড়িটা একবার ওঠার চেষ্টা করলো। পারল না। বসে পড়ল। তার পা দুটো কাঁপছে।
ছেলেটা রাস্তার ওপরে তিনটে ডিগবাজি খেলো। ডিগবাজি খেয়েই সোজা দাঁড়িয়ে গেল। তারপর বুড়িটার দিকে এক দৌড়ে গিয়ে থমকে দাড়াল। বুড়িটার চোখে চোখ রাখল। বলল, উবু... দশ... কুড়ি... তিরিশ... চল্লিশ... পঞ্চাশ... ষাট.... বুড়িটা ফ্যালফ্যাল করে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে। ছেলেটার জোরে জোরে নি:শ্বাস ফেলা, নাকের পাটাদুটো ফুলে ওঠা, সারা মুখ বিন্দু বিন্দু ঘামে ভরে ওঠা --- বুড়িটা খেয়াল করছে। কাঁপা কাঁপা হাতে বুড়িটা কাঁধ থেকে আঁচলটা নিয়ে ছেলেটার মুখে চেপে চেপে ঘাম মোছাতে লাগল। ছেলেটা বুড়িটার কোলে মাথা দিয়ে চিৎ হয়ে শুল। একটা পায়ের ওপর পা তুলে পায়ের পাতা দোলাতে দোলাতে বলল, আজকে কি অষ্টমী? আমার নতুন জামা কই? আজ তো অষ্টমী। বাবা নতুন জামা আনবে। ছেলেটা দৌড়ে গেল।
বুড়িটা যতক্ষণ দেখা যায় ছেলেটাকে দেখল, ছেলেটার বয়স চোদ্দো বছর। বুড়িটা আস্তে আস্তে উঠল। গাছের পিছনের দিকে গেল। লাঠিটা নিল। হাঁটতে শুরু করল। ঝোপের কাছ থেকে শুকনো কাঠ আঁটি করা, একহাতে বগলদাবা করে তুলে নিল। বাড়ী পৌঁছাল যখন সন্ধ্যে হব হব। তার বৌমা উনানে আঁচ দিচ্ছিল। তাকে বলল, শিবেন আসেনি এখোনো?
বৌ'টা উত্তর দিল, না।
বুড়িটা কাঠের ঝাঁকা উনানের পাশে নামিয়ে বলল, আমি গা ধুয়ে আসি।
লাঠিটা ঠুকতে ঠুকতে বাড়ীর পিছনের পুকুরের ধারে এল। তাদের পুকুর না। পুকুরটা মৈত্রদের। ধীরে ধীরে পুকুরে নামল। পশ্চিম আকাশটার দিকে তাকাল। সম্পূর্ণ লাল। পায়ের কাছটা জ্বালা জ্বালা করছে, কনুইয়ের কাছটাও। ছিলে গেছে মনে হয়। কোমরটা টাটাচ্ছে। মাথাটা ডোবাবে না ডোবাবে না করেও ডুবিয়ে ফেলল। ডুব দিয়ে উঠেই দেখে তীরে শিবেন দাঁড়িয়ে। সম্পূর্ণ উলঙ্গ। বলল, দ্যাখ ঠাম্মা, বাবা নতুন জামা দিয়েছে।
বুড়িটা আবার ডুব দিল। ডুব সাঁতারে পুকুরের মাঝ অবধি এল। মাথাটা তুলে আঁচলটা মুখে আটকে পাড়ের দিকে তাকাল। শিবেন চিৎকার করে বলছে, তুই বাড়ী আয়। তোর জন্য বাবা শাড়ী এনেছে। আজ নবমী তো।
বুড়ীটা আবার ডুব দিল। যতক্ষণ জলের মধ্যে দমবন্ধ থাকা যায়...
উলঙ্গ শিবেন সর্ষে ক্ষেতের ভিতর দিয়ে দৌড়াচ্ছে। ঠাকুর খুঁজছে। তার পিছনে পিছনে তাদের বাড়ীর পোষা কুকুর। এতক্ষণ কোন পাড়ায় ছিল কে জানে। শিবেন হঠাৎ ঘুরে সেটাকে দেখে বলে, তুই কি সিংহ? বলে তাকে ধাওয়া করে। কুকুরটা খেলা ভেবে দু'পা দৌড়ায়, আবার থমকে তার দিকে ফিরে তাকায়। হঠাৎ শিবেন খেয়াল করল, সে শূন্যে উঠে যাচ্ছে। তার বাবা তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যেতে এসেছে। শিবেন চীৎকার করছে, স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। তুমি হরেন মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করো, আমি সব অঙ্ক করেছি। দূরে বিভিন্ন বাড়ী থেকে শাঁখের আওয়াজ আসছে।
লোকে বলে, শিবেনকে নাকি কে ছোটবেলায় ধুতুরা খাইয়েছিল। শিবেনের ঠাকুমা বিশ্বাস করে না। শিবেনের ঠাকুর্দার সাথে শিবেনের কোথায় একটা যেন মিল। গঙ্গার পাড়ে পলি শুকোলে হাঁটা যায়। কিন্তু ভিজে থাকলে পা ডেবে ডেবে যায়। হাটা যায় না। শিবেনের ঠাকুর্দা ছিল যেন শুকনো পলি, শিবেন ভিজে। বর্ষায় শিবেনের ঠাকুর্দা শিবেন হয়ে উঠত।
শিবেনের ঠাকুমা সন্ধ্যে দিতে দিতে শুনতে পাচ্ছে পাশের ঘরে শিবেন গোঙাচ্ছে। বলাই মারছে। এরপর দড়ি দিয়ে বাঁধবে। তারপর হাসপাতালের ডাক্তারের দেওয়া কি এক ওষুধ খাওয়াবে। ছেলেটা ঝিমোবে।
শিবেনের ঠাকুমা শাঁখে ফুঁ দিল। একবার... দু'বার... তিনবার...। জপের মালাটা হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে কুঁজো পিঠটা দেওয়ালে এলিয়ে বসল।
মাঝরাত। বাইরে ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। সারা গ্রাম ঘুমোচ্ছে। শিবেনের ঠাকুমা তার চৌকিতে উঠে বসল। জানলাটা দিয়ে বাইরে তাকাল। বাইরেটা জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। শিকলটা খুলে বাইরের উঠোনে এসে দাড়াল। শিবেনের পা-দুটো দড়িতে বাঁধা। বুড়ি ধীরে ধীরে তার কাছে এসে দাঁড়াল। অঘোরে ঘুমোচ্ছে ছেলেটা। মুখ থেকে লালা পড়ে মাটির মেঝে ভিজছে। আস্তে আস্তে ওর পায়ের দড়ি দুটো খুলল। শিবেন ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, আমসত্ত্ব এনেছিস?
শিবেনের ঠাকুমা বলল, ঠাকুর দেখতে যাবি চল।
কাঁধে একটা কলসী আর গামছা নিয়ে ফাল্গুনের হাল্কা হাল্কা শীত-জ্যোৎস্নায় বুড়ি নাতিকে নিয়ে পুকুর ঘাটে চলল। পিছনে পিছনে কুকুরটা।
কুকুরটা নাকি সারা রাত বিচ্ছিরিরকম ডেকেছিল। গ্রামের লোক টের পায় নি। শুধু পুকুরের জলের ওপর পড়া চাঁদের প্রতিচ্ছবিটা কিছুক্ষণ এলোমেলো হয়ে ঢেউ খেলে আবার শান্ত হয়ে গিয়েছিল...