আসামীর সাজা ঘোষণা হয়ে গেছে। এদিকে তাও সে কাঠগোড়ায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। বিচারক বললেন, তুমি কিছু বলবে?0
আসামী হাসল। বলল, বলি?
বিচারক বললেন, কি মুশকিল, বলবে বইকি.. বলো….
আসামী বলল, আজ্ঞে জগতে যদি সত্যি ন্যায়বিচার থাকত, তবে হুজুর আপনার সামনে দাঁড়াবার অনেক আগেই আমি হাওয়া হয়ে যেতাম….
বিচারক ভুরু কুঁচকে বললেন, মানে?
আসামী বললে, মানে আর কি, অনেক এমন মানুষ আর নেই, যাদের থাকার কথা ছিল… আবার এমন অনেক মানুষ আছে, বহালতবিয়ত আছে, যাদের থাকার কথা নয়… আসলে কত্তা জগতে ন্যায়বিচার নাই…. আপনাদের এ এক ব্যবস্থা আছে বটে… প্রমাণ এনে, তক্কাতক্কি করে… কিন্তু হুজুর জগতের আনাচে-কানাচে কিস্যু নেই….
বিচারক বললেন, সে বটে…. জগত কর্তার আইন… বোঝা শক্ত…
আসামী আবার হাসল। বলল, আইন নেই।
বিচারক বললেন, আছে হে আছে, সে আমাদের বুদ্ধিতে ধরা পড়ে না। নইলে এত বড় সংসার কি এমনি এমনিই চলছে?
আসামী বলল, না চলে উপায় নেই বলেই চলছে হুজুর। যা ঘটছে তা-ই ঘটার বলেই ঘটছে… নিয়ম আছে… ন্যায়বিচার নেই….
বিচারক বললেন, ন্যায়বিচার কি নিয়মের মধ্যে পড়ে না?
আসামী বলল, পড়ে কি হুজুর? আম পাকার নিয়ম আছে… আম চুরির কি নিয়ম আছে?… কেউ করে স্বভাবে… কেউ খিদেয়.. কেউ ক্ষতি করবে বলেই…
বিচারক বললেন, হ্যাঁ, বিচার সেই অনুযায়ীই হবে…
আসামী গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, হুজুর, হয় না। মানুষের গভীরে কি যে এক আশ্চয্যি আলো আঁধারি হুজুর। ভাবতে গেলে গা শিউরে ওঠে। সবার মধ্যেই আছে। আপনার মধ্যে নেই হুজুর?
বিচারকের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। মনের মধ্যে সাজানো বাগানে ঝড় উঠে গেল। এমন সব শিকড় উপরে উঠে এলো যা আসলে মাটির নীচেই চাপা থাকা ভালো। বিচারকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
বিচারক একটা কড়া কথা শোনাতে যাবেন। কিন্তু কাঠগড়ায় কে? কেউ নেই তো। বিকেলের আলো জানলার রডগুলোর ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছে আদালতে। আলো আঁধারির ডোরাকাটা দাগ। কাগজের খসখস, ফিসফিস শব্দ আনাচে-কানাচে। মাথাটা ঘুরছে। কোথাও বেরোনোর দরজা দেখতে পাচ্ছেন না। হাতের আঙুলের কড় কে উলটো দিকে গুনছে। সময় হুড়মুড় করে পিছোচ্ছে। অন্ধকার একটা গর্তের দিকে ঘূর্ণীর মত নেমে যাচ্ছে সব। মাঝে মাঝে জোনাকির আলোর মত স্ফুলিঙ্গ জ্বলে জ্বলে নিভে যাচ্ছে।
বিচারক মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে। মাথাটা একটা কাঠের টেবিলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ফেটেছে। রক্তের স্রোত আলো আঁধারি বেয়ে নদীর মত বয়ে যাচ্ছে। রক্তের মধ্যে বুদবুদ। বুদবুদে আটকে অজস্র প্রতিবিম্ব।