Skip to main content

(তখন বৌদ্ধদের একে একে পরাজিত করে ফেলছেন কুমারিল ভট্ট। রচিত হচ্ছে ভারতীয় আস্তিক দর্শনের এক নতুন অধ্যায় - পূর্ব মীমাংসা। কিন্তু সে নিয়ে শুরু হলেও এ গল্প শুধুই গল্প। মানুষের হৃদয়ের কি কোনো দর্শন হয়? তার কি কোনো ব্যাখ্যা, ইতিহাস হয়? সে চিরকাল আদিম, অকৃত্রিম। এ গল্প শুধু সেই সময়টুকুতেই জন্মেছে, প্রেক্ষাপট হিসাবে। বাকি তো মানুষের গল্প, দর্শনের ভাষায় নয়, মানবী ভাষায়।)

    গাছের পাতা ছিঁড়ে নিলে গাছ মরে না, মানুষের মত, সব সুখ ছিঁড়ে নিলেও মানুষ মরে না। শিকড় উপড়ে নিলে গাছ মরে যায়, মানুষের মত, আশা উপড়ে নিলে মানুষ বাঁচে না আর।

    ব্রহ্ম মানুষের আশা। শুধু দর্শনে মানুষ বাঁচে না। শুধু নৈতিক নিয়মে মানুষকে বাঁধা যায় না। মানুষ সহস্র দুঃখ সহ্য করে নিতে পারে যদি তাকে স্বপ্ন দেওয়া যায়। আশা দেখানো যায়। কুমারিল পেরেছেন।

    অনন্ত সকালেই বেরিয়ে পড়ল। আজ একজন বাঘা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর সঙ্গে তর্কযুদ্ধ আছে। নির্বাণ মানুষকে আশা দেয়? অনাত্মা মানু্ষের সব ভরসা কেড়ে নিয়ে তাকে রাস্তায় বসিয়ে দিয়েছে। ছি ছি….. এই কি উপনিষদের মত!

    তর্কসভায় থিকথিক করছে লোক। অনন্ত নারায়ণকে স্মরণ করে বসলেন তর্কসভায়। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী শুরু করলেন,

    আপনি আত্মার অস্তিত্ব সম্বন্ধে কি প্রমাণ দিতে পারেন?

    জীবের চেতনার উৎসই আত্মা।

    সন্ন্যাসী বললেন, চেতনা কি?

    অনন্ত বললেন, তিনিই ব্রহ্মের অংশ।

    সন্ন্যাসী বললেন, ব্রহ্ম কল্পনা।

    কে করেন কল্পনা?

    অনন্তের স্ত্রী সুখময়ী দুপুরে বসে বসে একটা কাঁথা সেলাই করছে। স্বামীর উত্তেজনার আঁচ যেন এই যোজন যোজন দূর থেকেও অনুভব করতে পারছে। মানুষটা ক্ষেপে উঠেছে যেন। কুমারিল ভট্ট'র সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই যেন ভূতে পেয়ে থাকে মানুষটাকে। সারাদিন পুঁথির মধ্যে ডুবে বসে থাকে, নাওয়া খাওয়ার সময়ও নেই তাঁর।

    আছিস বাড়ি?

    শ্যামাঙ্গী এলো। পাশের বাড়ির মেয়ে। নতুন বিয়ে হয়ে এসেছে। সুখময়ীর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার। যদিও অনন্ত পছন্দ করে না খুব একটা। কারণটা সহজেই অনুমেয়, শ্যামাঙ্গীরা বৌদ্ধ।

    শ্যামাঙ্গী খাটে বসেই বলল, তোর বরের আজ তো বৌদ্ধবধের পালা? নাকি রে?

    সুখময়ী সেলাইগুলো গুটাতে গুটাতে বলল, রাখ তো!

    শ্যামাঙ্গী পা তুলে খাটে বসেছে। জানলা দিয়ে হল্কা আসছে গ্রীষ্মের দুপুরের। শ্যামাঙ্গী বলল, আয় বোস। আমরাও একটু তর্ক করি…. বলো পণ্ডিত, এ জগৎ মিথ্যা না সত্য?

    সুখময়ী গলাটা যতটা সম্ভব গম্ভীর করে বলল, গৃহে খাদ্যের অভাব না ঘটিলে স্বপ্ন, অভাব ঘটিলে সত্য…. খাঁটি সত্য…

    শ্যামাঙ্গী হাসি চেপে গম্ভীর হয়ে বলল, চার্বাকদের ন্যায় বস্তুসর্বস্ব কথা বলো কেন পণ্ডিত?

    সুখময়ী বলল, আত্মার অস্তিত্বের জন্য ভাবিত নহি ভন্তে, পাকশালায় প্রবেশিলে স্বামীর রসনা ব্যতীত আর কিছুই স্মরণে রাখা দুষ্কর। ব্রহ্মার তেজ তবু বা সহ্য হয়, কিন্তু স্বামীর ক্ষুব্ধ রসনার জ্বালাময়ী বাক্য মর্ম এতাদৃশ ভেদ করিয়া যায়, সন্দেহ হয় মর্মে আদৌ সত্যকারের আত্মা রহিলে এদ্দিন বসিয়া থাকিয়া সহ্য করিতেছে কি করিয়া!

    শ্যামাঙ্গী সুখময়ীকে জড়িয়ে তার গালে একটা চুমু খেয়ে বলল, তবে তোমার হার হল সখী। তুমি অনাত্মায় বিশ্বাস স্থাপিলে।

    রাত হল। সুখময়ীর চোখে ঘুম নেই। অনন্ত আসার আগে শঙ্কর বলে আরেক পণ্ডিতের সঙ্গে দেখা করে আসবে বলেছে। গুমোট গরম।

    হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল। সুখময়ী ধড়মড় করে উঠে বসে শুকনো গলায় জিজ্ঞাসা করল, কে?

    আবার টোকা পড়ল দরজায়। সুখময়ীর শ্বাস দ্রুত হচ্ছে। ঘাম হচ্ছে। দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল আবার, কে?

    দরজার ওপার থেকে আওয়াজ এলো, আমি সৌম্যসুন্দর, দরজা খোলো।

    সুখময়ীর শিরদাঁড়া বেয়ে হিমের স্রোত নেমে গেল। সৌম্য এত রাতে?

    দরজা খুলে দিল। সৌম্য ঘরে ঢুকেই সুখময়ীকে আলিঙ্গন করে ঠোঁটের উপর নিজের সমস্ত জোর দিয়ে নিজের ঠোঁট বসিয়ে দিল। সুখময়ীর মনে হল তার ঠোঁটের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা। তারার আলো এসেছে জানলা দিয়ে ঘরে। কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। আজ অমাবস্যা। সৌম্যের ঘামে ভেজা শরীরকে সমস্ত শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরল সুখময়ী।

    ঠোঁট থেকে নিজেকে তুলে সৌম্য সুখময়ীকে টেনে নিয়ে খাটে বসালো। তারপর বলল, হাত পাতো।

    সুখময়ীর চোখ একহাতে চাপা, সৌম্যের হাত।

    সৌম্য বলল, হাতটা মেলো।

    সুখময়ী হাত মেলল। সৌম্য তার হাত বেলফুলে ভরিয়ে দিল। সুখময়ীর চোখের থেকে হাত সরিয়ে বলল, দেখো।

    সুখময়ী তারার আলোয় দেখল সৌম্যকে, তারপর তাকালো হাতের আঁজলা ভরা বেলফুলের দিকে। চোখ উপচে এলো জল। এ তাদের গ্রামের উজল দীঘির ধারে ফোটা ফুল। এতটা রাস্তা শুধু এই ফুলগুলো দিতে এসেছে তাকে!

    সৌম্য সুখময়ীর কপালে, চোখের পাতায় চুম্বন করে বলল, শুকিয়ে গেছে সুখী। কিছু মনে কোরো না।
    
    সুখময়ী জড়িয়ে ধরল সৌম্যকে, তার হাপুস কান্নায় ভেসে যাচ্ছে সৌম্যের ঘামে ভেজা বুক। উষ্ণ চোখের জলের ধারা সৌম্যের বুকের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। সৌম্য সুখময়ীকে সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে বলল, তুমি আমার।

    কেউ কোনো কথা বলছে না। তারাগুলো গ্রীষ্মের আকাশে গুটিগুটি পায়ে এদিক থেকে ওদিক চলে যাচ্ছে। সৌম্যের বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে সুখময়ী। ঘুম নেই দু'জনের চোখে।

    সুখময়ী বলল, হ্যাঁ গো, সংসারে তর্ক করা ছাড়া মানু্ষের কি কোনো কাজ নেই গো? উনি কেবল তর্ক করেন। কেন?

    সৌম্য কোনো উত্তর দিল না। সুখময়ীর কপালে এসে পড়া চুলের গুচ্ছকে সরিয়ে দিয়ে, মাথাটা একটু উঁচু করে নাকের ডগায় একটা চুমু খেয়ে বলল, তথাগতই জানেন।

    চুপ করো, সুখময়ী বলল। তারপর বলল, দেখো, মানুষ কি নিয়ে বাঁচে? হৃদয় নিয়েই তো? সে হৃদয়ে আত্মা থাকুন চাই না থাকুন, কি এসে যায় বলো?

    সৌম্য হেসে বলল, তুমি কি চার্বাক?

    সুখময়ী হেসে বলল, শ্যামাঙ্গীও তাই বলে।

    কে শ্যামাঙ্গী?

    সুখময়ী বলল, সে আছে একজন।

    সৌম্য বলল, যাবে?

    সুখময়ী বলল, কোথায়?

    সৌম্য বলল, পশ্চিমে।

    সুখময়ী বলল, চুপ করো।

     

    অনন্ত জয়ী হয়েছে। সগর্বে জয়তিলক কপালে এঁকে যখন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো, মনে কেমন সংশয় জন্মালো। বাড়ির সামনে এত জঙ্গল হল কি করে? সুখময়ী কি মারা গেছে? একজন জয়ী পণ্ডিতের বাড়ি থাকবে এমন অলক্ষ্মী ঘিরে? কুমারিল, শঙ্কর কারোর উপর কোনো শ্রদ্ধা নেই সুখময়ীর, সে যেন চার্বাকপন্থী। শুধু সুখ খোঁজে। জ্ঞান, তর্ক বিড়ম্বনা তার কাছে। মূর্খ নারী।

    শূন্য ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালো অনন্ত। মাথায় আগুন ছুটে যাচ্ছে। সুখময়ীর কাপড় একটাও নেই ঘরে। ভ্রষ্টা, কুলক্ষণা নারী। নরকগামী হবে! বারাঙ্গনা! হা ভাগ্য!

    শ্যামাঙ্গী এসে বাইরে দাঁড়ালো। বলল, আপনার ঘরে রন্ধন নিমিত্ত হয় তো কিছু নেই। আমি দিয়ে যাই যদি আজ্ঞা করেন। সুখময়ীকে আপনি হারিয়েছেন।

    সে ভ্রষ্টা! সে ইন্দ্রিয়পরবশ! সে পাপিষ্ঠা আমার যোগ্যই ছিল না কোনোদিন..., গর্জে উঠল অনন্ত।

    শ্যামাঙ্গী হেসে উঠল খলখল করে। তারপর চলে গেল নূপুরের শব্দ তুলে অনায়াসে।

    অনন্তের প্রাণে সে হাসির শব্দ, নূপুরের শব্দ শেলের মত বিঁধল। যেন সমস্ত যুদ্ধে হেরে গেছে সে। কান্না পেল। বুকের উপর যেন অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে গেল কেউ।

    অনেক রাত। অনন্ত শুয়ে বিছানায়। বর্ষার আকাশ ভীষণ উগ্র। যেন সারা পৃথিবী ভেসে যাবে আজ। কিভাবে শান্ত করবে নিজের চিত্ত? এ শিক্ষা তো হয়নি তার। তার্কিক মস্তিষ্ক শাণ দেওয়া অস্ত্রের ভাণ্ডার শুধু। সেখানে শান্তিজল কই?

    কাঁদতে চাইলেও কাঁদতে পারল না অনন্ত। সারারাত কি ভীষণ যন্ত্রণায় কাটিয়ে ভোরের দিকে চোখে নেমে এলো শ্রান্তিহরা ঘুম।

    অনন্ত দীঘি থেকে স্নান করে উঠছে। পা কাটল শামুকের খোলে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বসন্তের পলাশ ঝরা মাটি। মাথা নীচু করে বসল সুখময়ী। আঁচল ছিঁড়ে বাঁধল পা। রাতে ধুম জ্বর এলো অনন্তের। এক পক্ষকাল যেন ঘোরে কাটল। লোকে বলেছিল সুখময়ী ফিরিয়ে এনেছে সাক্ষাৎ যমের দুয়ার থেকে।

    ঘুম ভাঙল অনন্তের। এখনও বৃষ্টি হচ্ছে অঝোরে। সমস্ত জগত শূন্যময় মনে হচ্ছে। শান্ত মন। অভুক্ত শরীরে ক্লান্তি নেই, অবসাদ আছে। কানে বাজছে কি এক সুর! কেন? বুদ্ধং শরণম গচ্ছামি…. ধম্মং শরণম গচ্ছামি…. সংঘং শরণম গচ্ছামি….

    না পাঠক, অনন্তকে আর কেউ দেখেনি কোনোদিন। কোনো বৌদ্ধসংঘে না, কোনো তীর্থে না। প্রাণের সলিলে জীবন যখন স্বচ্ছ হয়ে ধরা দেয় তখন আর তার বাইরের আশ্রয় লাগে না। সে নিজেই নিজের আশ্রয় তখন। তাই কোনো ইতিহাসের পাতায়, কি শাস্ত্রের পুঁথিতে অনন্তের নাম লেখেনি কেউ। কিছু মানুষ হারিয়ে গিয়ে জীবন পায়, কিছু মানুষ নিজের প্রতিষ্ঠায় নিজেই কারারুদ্ধ হয়। অনন্ত আর সুখময়ী হারিয়ে গিয়ে গেল বেঁচে। প্রাণের সলিলে জীবনের স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়ে।