Skip to main content

হঠাৎ মেঘ করে এলো। বৃষ্টি শুরু হল। বর্ষায় যেমন হয়। কাজে বাধা। একটা গাছতলায় এসে দাঁড়ালাম। সামনে শিব মন্দির। সন্ধ্যে হচ্ছে।

একজন রোগা বয়স্ক মানুষ, সামনে একটু ঝুঁকে হাঁটতে হাঁটতে আসছেন, এক হাতে লাঠি, আরেক হাতে কোনোভাবে ছাতাটা মাথার উপর ধরে।

ছেঁড়া ধুতি, ময়লা পাঞ্জাবি, সেও জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া…. চারদিকের এত চাকচিক্যের মধ্যে ভীষণ বেমানান। যেন আঙুল উঁচিয়ে ব্যঙ্গ করছে শপিংমলের আলো, ঝাঁ চকচকে দোকান, সচ্ছল সুখী মানুষের ঢল… তুমি যে বড্ড বেমানান হে!

তিনি লাঠিটা, ছাতাটা মন্দিরের সিঁড়ির ধারে রাখলেন। সিঁড়ির হাতল ধরে ধীরে ধীরে উঠলেন বারান্দায়। বারান্দার সামনে দরজা, গর্ভগৃহে শিব।

তিনি দরজার সামনে হাঁটু মুড়ে বসলেন, শরীরটা ঝুঁকিয়ে, মাথাটা সিমেন্টের চৌকাঠে রাখলেন, দুটো হাতও রাখলেন চৌকাঠে। আশ্রয়।

মুহূর্তে সব বদলে গেল। তুচ্ছ সাধারণ একজন মানুষ, নিজেকে সঁপে দিচ্ছেন নিখিলাত্মার পায়ে। নিজেকে যুক্ত করছেন মহতের সঙ্গে। বিশ্বাসে। মুহূর্তেই সবটুকু সীমাবদ্ধতা, দীনতা লীন হয়ে গেল ওঁর ওই সবটুকু উজাড় করে দেওয়ার অকৃত্রিম আন্তরিকতায়। কোথাও একবিন্দু ফাঁক নেই তো!

এমন করে মহতের পায়ে নিজেকে সঁপে দেওয়া কি এত সোজা! এমনভাবে নিজের সঙ্গে গোটা সংসারের সার যে সত্য তার বিশ্বাসে, তার সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তা খুঁজে নেওয়া, একি সাধনা নয়?

আজ চিকিৎসক দিবস। ডাক্তার জর্জ চ্যাণ্ডির কথা মনে পড়ছে। বহু পুরষ্কারে, সম্মানে ভূষিত। লিভার বিশেষজ্ঞ। এক সময় ভেলোর সিএমসি-র কর্ণধার ছিলেন। মায়ের চিকিৎসা সূত্রে বহুবার সাক্ষাৎ হয়েছে। মুগ্ধ হয়েছি ব্যবহারে।

ওঁকে দেখেছি হাস্পাতালে ঢুকেই আগে চার্চে যেতেন, যেটা হাস্পাতালের কেন্দ্রেই, হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসতেন ক্রসের সামনে। চোখ বন্ধ থাকত। কি যে প্রসন্নতা, আত্মবিশ্বাসের মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠত সে ভাষায় কি বোঝানো যায়?

একবার মাকে নিয়ে ওঁর চেম্বারে বসে। ভেলোরেই। একজন ওঁর চেম্বারে ঢুকলেন, কিছু ফাইল নিয়ে, সামান্য কিছু কাজই করেন নিশ্চয়ই উনি। ডাক্তার চ্যাণ্ডি একগাল হেসে বললেন, বাহ, তোমার জামা তো দারুণ চকচক করছে….. দারুণ দারুণ……

সে হেসে বলল, নতুন….

কথাটা এমন কিছু নয়। কিন্তু ওই যে মহত্বের এক স্বভাব আছে চারদিকে মহত্বই নজরে আসে। সেই তার আশীর্বাদ। সংসারকে সত্যিকারে গোটাটা জানা কোনো মানুষের ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে সম্ভব নয়। কিন্তু তার আলোকিত দিকটাকে খুঁজে পান যে মানুষ অনায়াসে সে অবশ্যই মহৎ। তাঁর সান্নিধ্যও একরকম দিব্য মহত্বে নিয়ে যায়।

আজ যখন এই হতদরিদ্র মানুষটা অমন আন্তরিকতার সঙ্গে নিজেকে পূর্ণভাবে সঁপে দিচ্ছিলেন, আমার জর্জ চ্যাণ্ডির কথাই মনে পড়ল। এই মুখ আমি দেখেছি। মনে হল ছবি তুলি। কিন্তু চোখ যা দেখতে পায় না। মন দেখে নেয় অনায়াসে।

আজ এক বন্ধু, আমার অনুরোধে "যখন তুমি বাঁধছিলে তার" গানটা গেয়ে পাঠালেন। তিনি বড় আন্তরিক গান। গানে অলঙ্কারের আতিশয্য থাকে না। ভাবের শুদ্ধ অবগাহন থাকে। যা সত্যিই দুর্লভ।

বৃষ্টি থামল। গানটা শুনতে শুনতে মনে হল, এই একই কারণে আমরা রবীন্দ্রনাথের সামনে আসি না? নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যেমন বলেছিলেন, উনি আমাদের কুয়ো থেকে বার করে আনেন। সংকীর্ণতা থেকে বার করে আনেন। উদ্দেশ্য তো একই। মহতের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করা। নইলে যে একা একা তো নিঃশেষ হয়ে যাব। মহাত্মা গান্ধী যেমন বলতেন, সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বালিতে এসে পড়লে শুকিয়ে যাবে…..

মহতের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। নিজের যোগসূত্রটা খুঁজে পাওয়া। এই তো! নইলে শিক্ষার আর কি দরকার ছিল? বৈধভাবে শুধু স্বার্থসিদ্ধি করে যাওয়া? ব্যস?