রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়েছিল। বৃষ্টি পড়ছে সকাল থেকে। একটা ময়লা চাদর জড়িয়ে লোকটা সামনের বাসস্ট্যাণ্ডের দিকে তাকিয়ে। হাতে চায়ের ভাঁড়। তার খেয়াল নেই জল জমতে শুরু করেছে। পায়ের পাতা ডুবে গেছে ইতিমধ্যে। একটা ফাঁকা সিগারেটের প্যাকেট জলে ভাসতে ভাসতে তার ডান পায়ের গোড়ালির দু'কড় উপরে ধাক্কা দিচ্ছে। লোকটা খেয়াল করছে না। ওর মাথার উপর মোড়ের বড় বটগাছ। বৃষ্টি ডালপালা বেয়ে পাতার প্রান্ত ছুঁয়ে ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে লোকটার জটার মত জট পাকানো চুলে। তারপর মাথার থেকে নেমে গালের দাড়িগুলোর ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে চোরাস্রোতে। সেখান থেকে গলা-ঘাড় বেয়ে নেমে ঢুকে যাচ্ছে চাদরের ভিতরে। তবু সে নির্বিকার।
দুপুরবেলা মেঘের আড়ালে বিকেলের আমেজে স্থির। লম্বা বিকাল যেন। রবিবার। রাস্তাঘাটে লোক চলাচল খুবই কম।
রাস্তাটার অন্যদিকে বাসস্ট্যান্ডের নীচে যে বউটা সে তার পোঁটলার উপর মাথা রেখে গভীর ঘুমে। দু-একটা মাছি তার ঠোঁটের কোনায়, চোখের বন্ধ পাতায়, নাকের ডগায় বসছে, উড়ছে। ঘুম ভাঙছে না। এমনকি মুখের চামড়াও কুঁচকাচ্ছে না। রাস্তার জল প্রায় বাসস্ট্যাণ্ড ছুঁই ছুঁই করছে।
একটা বাস গেল জোরে। জল ছিটকিয়ে লাগল বউটার সারা গায়ে। একটা মাছির গায়েও এক বিন্দু জল গেল গুলির মত। মাছিটা গাল থেকে উড়ে কপালে বসল। বউটা ঘুমাচ্ছে।
জানলা দিয়ে এই দু'জনকে অনেকক্ষণ ধরে দেখছিলেন বয়স্কা মানুষটা। জানলাটা বাসস্ট্যান্ডের পিছনেই। তিনি সারাটা দুপুর জানলায় দাঁড়িয়ে থাকেন। তার শাড়িটা আজ কাচা হয়েছে। তাই দোক্তার গন্ধটা হাল্কা। এখন অনেকক্ষণ দাঁড়াতে পারেন না। পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরে। তাই টুল নিয়ে আসেন একটা। বৃষ্টির ছাঁটের কয়েক ফোঁটা তাঁর মুখের উপর পড়েছে। বিন্দু বিন্দু ঠাণ্ডা অনুভূতি। একটা বিন্দুকে ডান আঙুলের তর্জনী নিয়ে ছুঁলেন। তর্জনীর সামনেটা ভিজে গেল। তিনি চোখের সামনে এনে চশমার নীচের অর্ধবৃত্তের আওতায় ধরলেন। ঠাণ্ডা অনুভূতি আঙুলের ডগায়। শুঁকলেন। জর্দার গন্ধ। জিভে ঠেকালেন, খয়েরের তিতে স্বাদ ঠেকল। গ্রামের পুকুর, তার পাশের সার দেওয়া নারকেল, দুপুরে কাজের শেষে মায়ের ঘুমন্ত মুখ, বাবার ভিজতে ভিজতে স্কুল থেকে ফেরা, টালির চালের উপর বৃষ্টির আওয়াজ - মনে পড়ে গেল।
তিনি ছাদের দিকে তাকালেন। পাখাটার আর কোনো কৌতুহল নেই তাঁকে নিয়ে। তাঁরও নেই। প্রথম প্রথম ছিল। যখন নতুন নতুন এই বৃদ্ধাশ্রমে আসেন। পাখাটাই প্রথম আপন করে নিয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে তার দিকে তাকিয়ে থাকত। যেন কত জীবন্ত। তাঁর আলমারিটার দিকে চোখ গেল। একটা জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরামের চাকতি। চুম্বকে আটকানো। তাঁর স্বামী কিনে দিয়েছিলেন পুরী থেকে। চুম্বকটার টানটা এখনও কমেনি। একটুও না।
বর্ষা এলে ভয় করে। বর্ষার পরেই পূজো। ছেলেমেয়েদের না আসতে পারার ফোন। আসল কথায় পৌঁছাতে ওদের আরো পাঁচটা অসংলগ্ন কথা। বুকের ভিতরটা ঢিবঢিব করে। উত্তরটা জানা থাকলেও করে। তার ভিতরটা চুম্বকের মত কি?
বউটা এখনও ঘুমাচ্ছে। লোকটাও দাঁড়িয়ে আছে। ওর পায়ের কাছ থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা ভেসে চলে গেছে। চা খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। কি দেখে লোকটা রোজ? বউটার সাথে কি ওর?
আলমারিটা খুললেন। দুটো দশ টাকা ব্লাউজের মধ্যে গুঁজলেন। কত মানুষ কাছে। অথচ অপরিচিত। বর্ষা মানুষকে আরো স্পষ্ট করে থমকে দিয়ে। চোখে পড়ে। বর্ষায় আটকে মানুষ ভাবে। বাইরে বেরোনোর চটিটায় পা দিলেন। ধুলো জমেছে। পায়ের নীচে ধুলো রাস্তায় নেমেই গলে গেল। উনি হাঁটছেন। সাদা শাড়িটার নীচে পাড়ের দিকে চটির কাদা ছিটকে লাগছে। পা কখনও কখনও জলে ডুবে। ছাতার উপর প্রাচীন বর্ষা। এখানে ওখানে মানুষ আটকে। ভাবছে। বর্ষায় আটকে মানুষ ভাবে। ওই তো সামনে মোড়ে লোকটা। পিছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। জলে পায়ের পাতা ডুবছে। বুকের ভিতর ধড়াস ধড়াস।
শুনছো?
লোকটা ফিরে তাকালো। অন্ধ।
ছাতার উপর তখন মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে।