Skip to main content

 

হঠাৎ বাড়ির পুরুষমানুষটা ঠিক করল, এখন থেকে কাজে যাবে না। মাঝে মাঝে বেড়াতে যাবে। আর যখন বাড়িতে থাকবে, তখন তার ঘুম থেকে উঠে চা, স্নানের পরে ভাত, শোয়ার আগে অল্প কয়েক ঢোক নেশার জিনিস জোগাড় রাখতে হবে।

কে রাখবে?

বউ আর ছেলে। বউ আরো কয়েক বাড়ি বাসন মেজে নেবে। ছেলে না হয় আরো কঠিন শ্রম দেবে, লেবারের কাজে।

সে পুরুষ কি অসুস্থ?

না। এমনকি না তো বয়স্ক।

=======

বুঝদার দরদী কে সংসারে? আছে কেউ, যার কাছে নিজের সব কথা বোঝানো যায়?

লোকটা বসে গেল। তাতে ধাক্কা নেই। কিন্তু সম্পর্কের একটা বিধি আছে। দুজনে মিলে খেটে বাড়িঘরদোর করবে। এখন তো ছেলেও রোজগেরে। সবাই মিলে খেটে সংসারটাকে সচ্ছল করবে। এমন একটা বিধিই তো ছিল সম্পর্কে। হঠাৎ তুমি ছেদ টানলে কেন?

আমার ইচ্ছা।

সংসারে ইচ্ছা বড়, না বিধি বড়? বিধি ডিঙিয়ে ইচ্ছা ঢোকালে সংসারে, মঙ্গল থাকে সেখানে আর? দেখোনি ওদের বাড়ি? অমন বউ থাকতে অন্য জায়গায় গিয়ে মুখ নষ্ট করে এলো…. সেকি বিধির কথা?

পুরুষ চোখ রাঙায়। বলে, আমি তোয়াক্কা করি না সংসারের। চলে যেতেই পারি। যেখানে সেখানে।

ছেলে বলে, যাও। বউ ভয় পায়। তবু বলে, যাও। ভয়ের চাইতে বিধি বড়। বিধির আগল থাকলে এই বেড়ার বাড়িও থাকবে, নইলে পাকাবাড়িও শ্মশান। যায় যাক।

পুরুষ বলে, অকৃতজ্ঞ। এদ্দিন খাইয়ে পরিয়ে সংসার টানলাম। এখন নিজের পাখা গজিয়েছে, এখন তো আমি গেলেই সুবিধা।

ছেলে বাইরে চলে গেল। এরপর কথা বললে বাবা বলে মান থাকবে না। বউ বলল, অলক্ষ্মীতে পেয়েছে তোমাকে।

======

পুরুষ গেল না কোথাও। বউ প্রথম প্রথম অভিমানী হল। তারপর বদমেজাজি। এখন রুক্ষ। রূঢ়ভাষী। অবিশ্বাসী।

=======

একদিন বৃষ্টির সকাল। মেঝেতে শাড়িটা ছড়িয়ে শুয়ে আছে বউ। ছেলে গেছে দীঘা। হঠাৎ পুরুষ বলল, আমার বুকে ভীষণ ব্যথা হচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

বউ উঠে বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। তার বাবা এইভাবেই মরে গিয়েছিল উঠানে শুয়ে। বউ তাড়াতাড়ি টোটো ডাকল। হাসপাতাল নিয়ে গেল। মরে যেতে যেতে ফিরে এলো। কিন্তু গোটা মানুষটা ফিরল না। আধমরা একটা জীব। অনেক নিষেধ দিয়েছে ডাক্তার। সে শুনলে তো? বিড়ির পর বিড়ির বিরাম নেই।

একদিন আশ্বিনের সকালে হঠাৎ করে মরে গেল পুরুষটা। একটা পা ঘরের মধ্যে আরেকটা উঠানে রেখে শুয়ে।

দাহ করে ছেলে ঢুকে মাকে খুঁজল। মা বসে আছে দীঘির পাড়ে। সাদা শাড়ি গায়ে।

ছেলে গিয়ে ডাকল, মা।

সাড়া দিল। বল।

ছেলে বলল, ঘরে এসো। সন্ধ্যে হয়েছে।

মা বলল, জানি।

উঠল না।

=====

এখন সব অবেলায়। খাওয়া, শোয়া, স্নান। লোকে বলে, অসুখে পড়বে তো!

তার মাথায়, বুকে, ঘাড়ে কোথাও সুখ নেই। ভাতে। জলে। বিছানায়। কোথাও তৃপ্তি নেই। শূন্য একটা জীবন। এত শূন্য করে দিয়ে গেল লোকটা?

বিছানায় বসে বসে ছেলেকে ফোন করল একদিন। পাশের পাড়ার চেনা লোক, পুরী নিয়ে যাচ্ছে। বেশি খরচ নয়। আধারকার্ড চেয়েছে। রিজার্ভেশন করবে।

ছেলে বলল, ইচ্ছা হলে যাও।

গলায় ঝাঁজ।

======

জগন্নাথ নয়, সমুদ্র নয়, শান্তি দিল রাস্তা। এতদিন হেঁটেছে চেনা রাস্তায়। সে রাস্তা যেদিকেই নিয়ে যেত ফেরার তাড়া দিত। এ রাস্তা ফেরার তাড়া দেয় না। হারিয়ে যেতেও বলে না। বলে, এখানেই থাকো। কী করবে কোথাও গিয়ে?

বেশিরভাগ সময় রাস্তায় ঘোরে সে। লোক দেখে। সংসারে একটা বিধি আছে। সে বিধি ছাড়িয়েছিল তার পুরুষ। তারপর সে। তার পুরুষ ছেড়েছিল ইচ্ছায়। সে ছেড়েছিল অভিমানে। জব্দ করতে নিজেকে।

=======

ফিরল বাড়ি। সে অন্য মানুষ। কেউ বলে বেশি কথা বলে। কেউ বলে হাসে কী, বাবা রে বাবা! কেউ বলে, অল্পতেই কেঁদে ফেলে। কী জানে মনে কী দুঃখ।

ছেলে দূরে দূরে থাকে। মাকে চিনতে পারে না। এত আলগা চোখ মায়ের কোনোদিন দেখেনি তো।

একদিন একজন জিজ্ঞাসা করল, দিদি, এত হাসছ যে!

সে বলল, আরে ছেলেটা ভালোবাসে বলে বড়ি দেব ভেবেছিলাম। তা বড়ি শুকুতে দিতে গেলে যে পাহারায় বসাতে হবে কাউকে সে তো ভুলেই গেছি….আমার ঘরে লোক কোথায়...পাহারা দেবে….তাই ডাল বাটা নিয়ে হাসছি….ভাবছি বড়া করে ফেলব….

“এইতেই হাসছ এত?”

হঠাৎ করে চোখে তার জল এলো। বলল, সে থাকলে তো পাহারাটুকু দিতে পারত বল….

“তুমি তো সুখী ছিলে না দিদি….”

তবু সে তো ছিল….

আজকাল তার সঙ্গে কথা কম বলে লোকে। এড়িয়ে যায়। তার সঙ্গে কথায় কথা জমে না। তাল কেটে দেয় সে। তার কথায় ঘরের চেয়ে পথের সুর বেশি। পথের সঙ্গে আবার কী কথা?