Skip to main content
 
 
       নকুড়বাবু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে আছেন। যে মানুষটা কথা বলছে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখদুটো, কথা বলার সময় জিভটার চলন, দাঁতের গঠন, নাকের ফোলা-কমা, মাঝে মাঝে ঠোঁটটা শুকিয়ে গেলে লোকটার জিভ দিয়ে ঠোঁটটা চেটে নেওয়া, কণ্ঠমণির ওঠানামা, হাতের নানা মুদ্রা, অস্থির হয়ে ঘাড় ঝাঁকানো... নকুড়বাবু মন দিয়ে দেখছেন। যে লোকটা কথা বলছে, আসলে সে কথা বলছে বললে ভুল হবে, সে নকুড়বাবুকে অপমান করছে। গালমন্দ করছে। শাপশাপান্ত করছে। নকুড়বাবু চুপ করে খেয়াল করে যাচ্ছেন সব।
       লোকটা সবটা বলার পর নকুড়বাবুর পায়ের কাছে একগাল থুথু ফেলে একটা খুব নোংরা কথা বলে হনহন করে হেঁটে চলে গেল, দেখতে দেখতে সব্জী বাজারের মধ্যে মিলিয়েও গেল। নকুড়বাবু বাজারের থলেটা নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। বাজার ছাড়িয়ে মোড়টা ঘুরতেই চোখটায় কি আরাম, কৃষ্ণচূড়া গাছটার সব ডালে ফুল, ডালগুলোর ফাঁক দিয়ে দিয়ে চৈত্রের নীল আকাশটা যেন মিশে আছে। একটা দোয়েল এ ডাল, সে ডাল লাফাচ্ছে। সাদা পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমালটা বার করতে গিয়ে দেখেন ফুলমণির রুমালটা নিয়ে চলে এসেছেন, লাল রঙের মেয়েদের রুমাল। যা হোক, তাই দিয়ে মুখটা মুছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলেন গাছটার শোভা। ঘড়ি দেখলেন, আটটা দশ। অফিসের দেরি আছে। সারাটা শরীর ঘামে চাপচাপ। মোটা মানুষ, বেঁটেখাটো, সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি ছাড়া কিছুই পরেন না। ওনার বাবাও তাই পরতেন, ছবিতে দেখেছেন, অনেক ছোটোবেলায় বাবা মারা যায়, তাই পড়াশোনাও হয়নি তেমন নকুড়বাবুর। কলকাতায় একটা মাড়োয়ারি ফার্মে ক্যাশিয়ারের কাজ করেন। সেই করেই ভাইগুলোকে মানুষ করেছেন, তারা ভালোই প্রতিষ্ঠিত, শুধু ছোটোভাইটা ছাড়া, সে মদ্যপ, লম্পট, জমিজায়গার দালালি করে, তাকে নিয়েই অশান্তি যত সংসারে। নইলে বাড়িতে তিনি আর ফুলমণির তেমন কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। ফুলমণির আগে শখ ছিল শুক্রবার করে সিনেমা বদলালেই ফার্স্ট শো দেখতে যাবে বকুলপ্রিয়া হলে, এখন আর যায় না। একে টিভি হয়ে গেছে, তায় বকুলপ্রিয়া এখন বহুতল আবাসন।
       এতক্ষণ যে লোকটা নকুড়বাবুকে গালাগাল করে গেল সে-ই নকুড়বাবুর ভাই। লোকে পদা বলে ডাকে। বিয়ে করেনি, কিন্তু শোনা যায় তার স্ত্রীর নাকি অভাব নেই এই চাকদায়। সে যখনই গালাগাল করে নকুড়বাবু তখনই তাকে ভাই না ভেবে একজন অন্য মানুষ ভাবে। নতুন করে দেখে, কত অপরিচিত লাগে। এই কৃষ্ণচূড়া গাছটার মত। এই গাছটা কি সারা বছর এমন থাকে? না তো, কখনও রুক্ষও হয়ে যায়। তার পাশের তেঁতুল গাছটা যেমন, তার কি এমন ফুল ফোটে? আসলেই মানুষ নানা রকম হয়, গাছের মত। আবার তাদেরও ঋতুতে ঋতুতে রঙ বদলায়, সে ঋতু পৃথিবীর আহ্নিকগতি বার্ষিকগতি ঠিক করতে পারে না, জীবনের একটা নিজস্ব আহ্নিকগতি আর বার্ষিকগতি আছে। সে একটা মহত্ত্বকে কেন্দ্র করে ঘোরে। জীবনের কেন্দ্রে একটা মহত্ত্ব আছে। সেই মহত্ত্বের যত কাছে যাওয়া যায় মানুষ তত উজ্জ্বল, যেমন রবীন্দ্রনাথ। সেই মহত্ত্বের কাছে সব মানুষই কখনও না কখনও যায় জীবনে, যেমন বড় আঘাতে, যন্ত্রণায়। হঠাৎ সেই মহত্ত্বের ছোঁয়া সে পায়, উদার হয়ে ওঠে, শান্ত হয়ে ওঠে, কিন্তু আবার সে ভুলে যায়, আবার সেই কেন্দ্র থেকে সরে দূরে চলে যেতে শুরু করে, ভুল হয়ে যায়। কারণ সে জানে না ওদিকে গেলে শান্তি নেই। মানুষ সুখ ছাড়া থাকতে পারে, কিন্তু শান্তি ছাড়া বাঁচতে পারে না।
       যেমন একবার কালবৈশাখী ঝড়ে টিটাগড়ের কাছে রেলের তার ছিঁড়ে গেল। বড়বাজার থেকে শিয়ালদায় এসে দেখেন মানুষে মানুষে থিকথিক করছে ভিড়। ট্রেন বন্ধ এক ঘন্টা হল। এখন সাতটা কুড়ি, ঘড়ি দেখলেন। হঠাৎ ফোন বাজল, মালিকের ফোন। তিনি খবর পেয়েছেন আজ ট্রেন বন্ধ। উনি প্রস্তাব দিলেন ওনার বাড়িতেই আজ রাতটা কাটিয়ে যাওয়ার জন্য, কারণ সদ্য ভয়ানক জ্বর থেকে উঠেছেন। কথাটা শুনেই নকুড়বাবুর মনে হল, গেলেই ভালো, শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। কিন্তু ফুলমণি জ্বরে পড়ে আছে, যদিও তার শালা আর শালার বউ আছে, ওরা এসেছে জ্বর শুনে, কিন্তু তবু উনি গেলেন। ট্রেন ছাড়ল সাড়ে আটটায়, আরো কয়েকটা জায়গায় তার ছিঁড়েছিল পরে জানা গিয়েছিল। কি প্রচণ্ড ভিড়, এই এত মানুষ কিসের জন্য বাড়ি ফিরতে চাইছে এই কষ্ট সহ্য করে? শান্তির জন্য। তাই এই অত্যাচার নিজের উপর নিয়ে নিচ্ছে হাসিমুখে।
       নকুড়বাবু বাড়ি ফিরে তোয়ালেটা নিয়ে স্নানে গেলেন। ফুলমণি পূজোয় বসেছে। এখন কথা বলবে না। নকুড়বাবু সব জামাকাপড় ছেড়ে বাথরুমের টুলটার উপর বসলেন। সামনে এক টব ঠাণ্ডা জল। একটু ডেটল দেওয়া। ফুলমণি করে রেখেছে। এতদিনের অভ্যাস, তবু নকুড়বাবুর কান্না পায় মাঝে মাঝে, জীবন তাকে যেন বড্ড বেশি দিয়েছে। আবার রবীন্দ্রনাথের মুখটা মনে পড়ল। ওনার মেয়ে অসুস্থ, আলমোড়ায় নিয়ে গেছেন চেঞ্জে। ওনার স্ত্রী মারা গেছেন তখন। মায়ের সব দায়িত্ব বাবা করছেন। রানীর অসুখ আরো বাড়ল, বুঝলেন ফিরতে হবে। কিন্তু ফিরবেন কি করে? কোনো গাড়ি নেই কাঠগোদাম স্টেশানে যাওয়ার জন্য। রাস্তা বাঁধানো পথে আশি মাইল প্রায়, আর জঙ্গল দিয়ে গেলেন তিরিশ মাইল। উনি কুলি ঠিক করলেন। তারা খাটে করে রানীকে নিয়ে নামবেন, উনি নামবেন হেঁটে। তাই হল। সারাটা পথ মেয়ের পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে যখন কাঠগোদাম স্টেশানে এলেন তখন সন্ধ্যে, ট্রেন ছেড়ে গিয়েছে। ডাকবাংলো চাইলেন, পেলেন না, এক সাহেব দম্পতি রুগী সাথে আছে শুনেও দিলেন না ঘর ছেড়ে। অগত্যা একটা ধর্মশালায় থাকলেন রানীকে নিয়ে সারারাত। পরের দিন ট্রেন। বিপদ এখানেও শেষ হল না। মোগলসরাই না কোন স্টেশানে জানি ওনার সব টাকা গেল চুরি। উনি প্রথমে উদ্বিগ্ন হলেন, সাথে রুগী, এতটা পথ যাবেন কিভাবে? তারপর নিজের মনকে বললেন, আচ্ছা না হয় মনে করলুম টাকাটা আমি তাকে দিয়েছি, তার দরকার ছিল বেশি। ব্যস, মন শান্ত হতে শুরু করল।
       নকুড়বাবুর সামনের টবে টলটল করছে ঠাণ্ডা মিউনিসিপ্যালটির কলের জল, নকুড়বাবুর চোখের কোণেও দুই বিন্দু জল। এত সহ্য করে কি করে মানুষ, তার কয়েকদিন পরে রবীন্দ্রনাথের কোলেই মাথা রেখে তো মারা গেল রাণী। নকুড়বাবু ঠাণ্ডা জল ঢালল মাথায়। চোখের জল আর এক বুক কান্না হুস করে বেরিয়ে গেল। 
       ফুলমণি খেতে দিচ্ছে। হঠাৎ বলল, তোমার চোখটা অমন লাল কেন গো? নকুড়বাবু ফুলমণিকে আজ অবধি মিথ্যা বলেননি, চুপ করে রইলেন। ফুলমণি একবার নকুড়বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, পোস্তর বড়া ভেজেছি, আনছি। নকুড়বাবুর আবার চোখ টাটালো, পাতাদুটোকে বড় করে সামলে নিলেন। সব মানুষের মধ্যেই একটা চক্র চলে মহত্ত্বকে ঘিরে, মানুষ যেতে চায় না কেন্দ্রের দিকে, কারণ সে লোভকে বেশি বিশ্বাস করে বুদ্ধির চাইতে, লোভী মানুষ বুদ্ধিমান হয় না, চালাক হয়। ফুলমণি বুদ্ধিমান। 
       নকুড়বাবু অফিসে বেরোবেন, হঠাৎ পদা ঢুকল, ওর গায়ে মদের গন্ধ, বলল, বউদি আছে? নকুড় বলল, হ্যাঁ আছে, কেন? পদা বলল, খিদে পেয়েছে, বউদি বলল, পোস্তর বড়া করেছে।
       নকুড়বাবুর নাকটা টাটালো, বলল, ভিতরে যা। পদা মাথা নীচু করে ঢুকে গেল। নকুড়বাবু হনহন করে স্টেশানের দিকে হাঁটছেন, সব মানুষের মধ্যেই করুণা থাকে, নিষ্ঠুরতায় জমে বরফ হয়ে যায়, শুনেছেন নকুড়বাবু কি একটা বরফ আছে তাতে নাকি মানুষ খুনও করা যায়। সে বরফকে গলাতে হয়, সেই বরফকে যে গলাতে পারে সেই ঈশ্বর। পদার বরফও গলবে, যেমন জগাই-মাধাইয়েরই বরফ গলেছিল মহাপ্রভুর ভালোবাসায়, ক্ষমায়। ক্ষমা মানে বেড়া হারানো ভালোবাসা, সবার কেন্দ্রেই আছে, বেড়া তুললেই হল।