Skip to main content
 
 
 
পর্ণা সানন্দাটা ভাঁজ করে কোলের উপর রাখতেই চমকে উঠল, সামনের প্ল্যাটফর্মে অনিকেত। অনিকেত দেখেনি। একটা চেয়ারে বসে খবরের কাগজে ডুবে আছে। সেই পুরোনো অভ্যাস।
        পর্ণা শ্যামনগর যাবে। সেখানে একটা হাইস্কুলে ভূগোল পড়ায়। পর্ণার ডিভোর্স হয়েছে বছর নয়-দশ হল। বিয়ে অনেক কম বয়সে হয়। তখন পর্ণা সদ্য গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। অনিকেতরাও নাগেরবাজারেই থাকত। তার থেকে বছর তিনেকের বড়, সদ্য মার্কেটিং এগজিকিউটিভের চাকরি পেয়েছিল একটা ওষুধ কম্প্যানীতে।
        বিধাননগরে কিসের জন্য একটা অবরোধ চলছে। একটা বাচ্চা ছেলে নাকি কাটা পড়েছে, অ্যানাউন্স না হতেই নাকি ট্রেন এসে গিয়েছিল। ছেলেটা স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে নাকি... পিপুলকে একটা ফোন করতে হবে, তাই বইটা নামিয়ে রেখেছিল পর্ণা। পাশে দু'জন হকার বলাবালি করছিল দেখেই মনে পড়ল ফোনের কথাটা আবার। পিপুল পর্ণা আর আর্যর ছেলে। তিন বছর বয়েস। পর্ণা এখন কৃষ্ণনগরে থাকে। আর্য নবদ্বীপের একটা স্কুলে ফিজিক্স পড়ায়। বাপের বাড়ি এসেছিল, পর্ণার বাবার শরীরটা ভালো নয়।
- লতা?(পিপুলের দেখাশোনা করেন)... জ্বর?... কখন থেকে... তুমি ক্রোসিন দিয়েছ?... ওর বাবা ফোন করেছিল... না আমিও পাচ্ছি না... জঙ্গলের ভিতরে তো... নেটওয়ার্ক নেই হয়ত... আচ্ছা আমি আসছি... দেখছি বড়দিকে ফোন করে...
        “বিধাননগরে অবরোধ চলার কারণে...”
        পর্ণা গায়ের সোয়েটারটা খুলে ব্যাগে ভরল। সকালের পরোটাটার একটা চোঁয়া ঢেকুর উঠছে। অম্বল হয়ে গেল মনে হচ্ছে। অমলেন্দু ডাক্তার অবশ্য একটা USG করতে বলছেন অনেকদিন হল। নাগেরবাজারেই বসেন। গলস্টোন সন্দেহ করছেন।
        অনিকেত এখনও পেপারে ডুবে। এক কাপ চা কখন নিয়েছে খেয়াল করেনি পর্ণা। এই চা ঠাণ্ডা হওয়া নিয়ে প্রায়ই অশান্তি হত। খবরের কাগজ, নয়ত গল্পের বই... একবার ডুবলে বিশ্ব-সংসার ভুলে যেত। পর্ণার একদম পড়তে ভালো লাগে না। না, এখন লাগে। আর্য একদম পড়ে না। পিপুলকে সে কেন যেন অনিকেতের মত দেখতে চায়। কিন্তু অনিকেতের কোনো অ্যাম্বিশান ছিল না। এটা ওদের বাড়ির একটা জেনেটিকাল ব্যাপার। ওর বাবা, মানে শান্তনুকাকু, রেলে একটা সামান্য কাজ করে কি সুখে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন। পৈতৃক বাড়ি, পুরোনো বাড়ি, কোনো ছিরিছাঁদ নেই, ইম্প্রোভাইজেশানের কোনো জায়গা নেই। তবু একটা ফ্ল্যাট কেনার কথা ভাবতে নেই। “এই তো এতবড় বাড়ি আছে, একটা মানুষের বাঁচতে ক'টা ঘর লাগে?” বাবা আর ছেলের এক কথা।
        জলের বোতলটা বার করল। আজ কপালে শনি আছে। ডাউনের ট্রেন প্যান্টোগ্রাফ ভেঙে বেলঘরিয়ার আগে দাঁড়িয়ে। দু'ঢোক জল খেলো। গলার কাছটার জ্বলুনিটা একটু নামল মনে হল। উপরের দিকে পেটটা চাপ ধরে আছে। প্ল্যাটফর্মে লোকের সংখ্যা বাড়ছে। অস্থিরতা বাড়ছে সবার। অনিকেত এখনও খবরের কাগজে ডুবে। একটা নীল জ্যাকেট, সেই জিন্সের প্যাণ্ট। চোখে চশমাটা বদলেছে। ফ্রেমটা বড়ো। একটু মোটা হয়েছে মনে হচ্ছে। ও এখানে থাকে না। রাঁচীতে থাকে। ওদের বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাট হয়েছে। কাকু কাকিমা নেই। বিয়ে করেছে? জানে না। ফেসবুকে সেরকম কিছু তো দেখেনি। যদিও ফ্রেন্ডলিস্টে নেই। তবু।
        একটু একটু গরম লাগছে পর্ণার। একবার টয়লেট ঘুরে এলো। ফিরে এসে দেখে বসার জায়গাটা দখল। একটা বুড়ো মানুষ বসে। সত্যি, কত তাড়াতাড়ি জায়গা দখল হয়ে যায়। আর কেউ না ভরাক তো শূন্যতা তো আছেই। শূন্যতাও কম হিংসুটে নয়! 
         একবার এসি লাগানো নিয়ে কি অশান্তি। ওটা নাকি বিলাসিতা! আসলে ওরা বাঁচাতেই জানে না। দিন কাটানো আর বাঁচা তো এক জিনিস নয়রে বাবা! যদিও সেই তীব্র খেদটাকে এখন তেমনভাবে অনুভব করতে পারল না পর্ণা আজ। আজ তার বাড়ি এসি, ওয়াশিং মেসিন, চারচাকা সব আছে। আর্যর বাবার বিরাট ব্যবসা রাণাঘাটে। তবু সুখের ঘড়া যেন পূর্ণই হতে চায় না। সুখের চেয়ে দায়িত্ব বেশি ভালো লাগে পর্ণার এখন।
- লতা?... জ্বরটা কমেছে?... বাঁচা গেলো... খেতে চাইবে না... তুমি একটু পাস্তা বানিয়ে দাও দেখো যদি... আচ্ছা...
        পর্ণা ফোনটা রাখতে গিয়েও রাখল না।
- কে স্বর্ণাভদা?... আমি পর্ণা বলছি... হ্যাঁ এটা আমার আরেকটা নাম্বার... হ্যাঁ দমদমে, ফিরছি... তুমি একবার বাড়ি যাবে গো... পিপুলের জ্বর... তোমার ভাইকে তো জানো, বন্ধুবান্ধব নিয়ে উড়িষ্যার কোন জঙ্গলে গেছে... ফোন দু'দিন ধরে স্যুইচ অফ্... যেমন থাকে আর কি... আচ্ছা... আচ্ছা... থ্যাংকিউ গো...
        বউটা ওরকম অসভ্যের মত তাকিয়ে আছে কেন? শাড়িজামা দেখে তো মনে হচ্ছে টিপিক্যাল মিডিল ক্লাস... দেখো গিয়ে মেয়ের বাড়ি কি ননদের বাড়ি এসেছিল দায়িত্ব মারাতে...
        পর্ণা রেগে গেলে মনের ভাষা নোংরা হয়ে যায়। অনিকেতের তাতেও আপত্তি ছিল। মেয়েমানুষের নাকি খিস্তি দিতে নেই... বাল... পর্ণা ইচ্ছা করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। স্বর্ণাভই ঠিক করেছে, বিয়ে থা করেনি, একটা কলেজে পড়ায়। মাস গেলে অঢেল টাকা... সেক্স আছে, এনজয়মেন্ট আছে... অত কমিটমেন্ট মারানো নেই... পর্ণাকে স্বর্ণাভই জিতে নিয়েছে একমাত্র, বাকিদের তো সে জায়গা দিয়েছে তাই... পর্ণার বুকটা টাটিয়ে উঠল মনে হল। 
- তুমি পর্ণা না? কাকলিদির মেয়ে?
- হ্যাঁ, আপনি? (সেই তাকিয়ে থাকা মহিলাটি) 
- আমি অনিকেতের দুঃসম্পর্কের মাসি। তোমাদের বিয়েতে গিয়েছিলাম। তোমার মনে নেই। গোবরডাঙায় থাকি। তোমাদের খবরটা শুনেছিলাম জানো... এত খারাপ লেগেছিলো... তবে তুমি তো বিয়ে করেছো আবার শুনলাম, বর নাকি খুব বড়লোক... বাচ্চা হয়েছে...? আর বোলো না, তোমার মেশোমশাই এই বছর চারেক হল মারা গেছে... এখানে একটা প্রাইভেটে কাজ করত... টাকা পয়সা নিয়ে যা ভোগাচ্ছে না... আমার একটা ছেলে... তা আর কি বলব... বউমা যা একখেন...
- অনিকেত কোথায় থাকে এখন মাসিমা? পর্ণায় গলায় যেন একটা ব্যাঙ্গের সুর। 
- ওমা জানো না...! সে তো রাঁচীতে এখন... বিয়ে করেছে... কি ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে কি বলব মা... আর আমারটাকে দেখো, ওই প্ল্যাটফর্মে দেখছো... ওই যে বসে আছে... আমার মণীশ... পুরো ওর দাদার মত দেখতে হয়েছে... না? ও কলকাতায় যাবে... তা আমায় বলল, তুমি একা যেতে পারবে না?...
        পর্ণার কান-মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে... "অবরোধ চলার দরুন আপে ট্রেন আসতে দেরি হচ্ছে... ডাউনে ট্রেনের প্যান্টোগ্রাফ ভেঙে পড়ার জন্য ট্রেন আসতে দেরি হচ্ছে..."
        পর্ণার ঘাম হচ্ছে। সে কিচ্ছু না বলে হনহন করে স্টেশানের বাইরে চলে এলো... স্কুলে যাবে?... না বাপের বাড়ি ফিরে যাবে... না কৃষ্ণনগরে একটা গাড়ি ভাড়া করে চলে যাবে?... তার তলপেটটা মোচড় দিচ্ছে... গা বমি বমি করছে... তবে কি গলস্টোন?... পায়খানায় যাবে?... একবার ফোনটা বার করল... একবার মণীশকে দেখল... সব্বাই তাকে ঠকিয়েছে... সব্বাই... সব্বাই...
        চোখ ফেটে জল আসছে, তার পায়খানা পাচ্ছে... বমি পাচ্ছে...
 
        পর্ণা একটা পাবলিক টয়লেটে ঢুকলো।
 
 
(ছবি – সুমন)