জঙ্গলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাছটা ক্রমশ নি:সঙ্গতায় আক্রান্ত হল। তার পাতা ঝরে গেল। কুঁড়ি কমে এলো। বুকের মধ্যে কান পাতলে অহর্নিশি হু হু বাতাসের শব্দ পাওয়া যেত। একদিন গাছটা মরে গেল।
গাছটা কাটতে কাঠুরে এলো। সঙ্গে এলো কাঠুরের বউ, মেয়ে, ছেলে। গাছ কাটতে কাটতে বেলা হল। কাঠুরের বউ, মড়া গাছটার পাশে চাদর পাতল। তারপর গামছা খুলে বড় বড় দুটো ঢাকা পাত্র থেকে ডাল, ভাত, আলুর তরকারি, পেঁয়াজ আর নুন বার করল। সবাই খেতে বসল।
বাচ্চা ছেলেটা একগাল খায়, দুবার মড়া গাছের গায়ে নেচে আসে। যেখানেই নাচে সেখানেই কিছুক্ষণের জন্য রঙ সবুজ হয়ে যায়। আশ্চর্য! মেয়েটা উঠে গিয়ে বলে, ভাই দাঁড়া, দাঁড়া।
ভাই দাঁড়ালো। মড়া গাছের উপর দাঁড়ালো। দিদি বলল, দেখ তোর পায়ের কাছে সবুজ, আর সেখানে কি সব লেখা!
=====
গাছটা আসলে ডায়েরি লিখে গিয়েছিল ডালে ডালে। তার মনে হয়েছিল কেউ পড়বে। ভাই বোন পড়তে শুরু করল।
=====
আমি কবে জন্মেছিলাম আমার আর মনে নেই। এই জঙ্গলেই আমি বড় হলাম। এই জঙ্গলের গাছপালা, আকাশ বাতাস মাটি জল, পাখিপতঙ্গ আমার আত্মীয় হল। আমি সুখী ছিলাম। আনন্দে ছিলাম। আমার ভিতর থেকে গান উঠত। আমার ডালে ডালে বৈশাখী ঝড়ে নাচ হত। দিন যেত, মাস যেত, বছর যেত।
একদিন আমার মনে হল আমি একা। একদম একা। জঙ্গল শুকিয়ে গেল? না। আকাশ মুছে গেল? না। পাখিপতঙ্গ কমে গেল, হারিয়ে গেল? না না না। বাতাস আগের মত শীতলতা ছেড়ে দিল? না। কিন্তু আমার মনে হতে শুরু করল আমি একা। আমার আসলে কেউ নেই। আমার আমি একটা বোঝা হতে শুরু করল। আমি প্রথম প্রথম কাঁদতাম। তারপর আর কান্না পেত না। সারাদিন বুকের ভিতর হু হু করা ডাক শুনতে পেতাম। আমার আমি আমারই গুঁড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে মাথা ঠুকত, আর বলত আমি কি করব? আমার কেউ নেই… কেউ নেই।
======
আমি বুঝলাম সমস্যাটা তৈরি করেছে আমারই আমি। কিন্তু তাকে কে তৈরি করল? আমি খুঁজতে শুরু করলাম। সময়ের খাতা পিছন দিকে উল্টালাম। একটা কিছু আভাস পেলাম। স্পষ্ট নয়, তবু পেলাম।
আমাকে অনেকে আঘাত করেছে, দু:খ দিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে। আমি সে সব নিয়ে দিনরাত ভেবেছি। নিজেকে বঞ্চিত, অত্যাচারিত, নিপীড়িত মনে হয়েছে। অনেক কিছু আমার সঙ্গে হওয়া উচিত ছিল না, তবু হয়েছে। আমার বারবার মনে হয়েছে, কেন আমারই সঙ্গে হয়েছে? কেন ওর তার সঙ্গে হয়নি। রাতদিন এই সব ভেবেছি। অন্যের সঙ্গে তুলনা করেছি। এই সব করতে করতে কখন আমার মধ্যে এই বিষাক্ত আমি তৈরি হয়েছে। আমারই অভিমান জমে জমে তৈরি হয়েছে। আমারই ঈর্ষা, আমারই হিংসা জমে জমে তৈরি হয়েছে। আমিই তৈরি করেছি। এখন সে আমাকে সবার থেকে আলাদা করে দিয়ে আমারই ভিতরে নিজের শূন্য রাজ্য বানিয়েছে। তার সে শূন্য রাজ্যে এমন এক সম্মোহনী শক্তি আছে যে আমি বারবার নিজেকে তার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছি। আমার বারবার মনে হয়েছে সে-ই সত্যি। জগতে একমাত্র সে-ই সত্যি। বাকি সব মিথ্যা। অপ্রাসঙ্গিক।
তবু আমি বুঝতে পারতাম কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে…কিন্তু কোথায় হচ্ছে তা আর খুঁজতেই চাইতাম না।
======
একবার এক সন্ন্যাসী এসে আমার এখানে ছিল তিনদিন। সে শুধু একটা লেঙট পরে ঘুরে বেড়াত। এখানেই রাঁধত। খেত। গান গাইত। নাচত। আবার গভীর ধ্যানে ডুবে যেত। সে যতদিন ছিল আমার মধ্যে এক আশ্চর্য সুখ জন্মেছিল। আমার নিজের দিকে তাকানোর সময় ছিল না। অথচ দেখো তার কেউ নেই এই জঙ্গলে। তার পায়ে পোকায় কেটে ঘা হল। সে পাতা বেটে নিজের পায়ে লাগাল। কিন্তু সেই পোকাকে কিচ্ছু বলল না। তার যেন কিছুতেই কোনো রাগ নেই, ক্ষোভ নেই।
একদিন রাতে জিজ্ঞাসা করলাম, কি গো… কিসের নেশা তোমার?
সে আগুন জ্বেলে বসেছিল। আমার প্রশ্ন শুনে খিলখিল করে হেসে ফেলল। তারপর বলল, পুড়াও… পুড়াও… সব পুড়িয়ে ফেলো… রাগ, অভিমান, ক্ষোভ… আমার এই পুড়ানোর নেশা….
=====
আমি পোড়ালাম না। জমালাম। রাতদিন নিজের দু:খের কাঁদুনি গাইলাম। যেন আমার থেকে দু:খী, বঞ্চিত, পীড়িত আর কেউ নেই। সবাই আহা-উহু করল। আমার সে আমি তাতেও জ্বলে উঠল। বলল, "সব লোকদেখানি। আমি আর কারোর কথা শুনব না আজ থেকে। তুমি সব দরজা জানলা বন্ধ করে দাও।"
তাই দিলাম। ধীরে ধীরে অন্ধকারে কখন যে মরণ এসে দাঁড়ালো…..
======
কাঠুরে সব কাঠ জড়ো করে বাড়ি নিয়ে এলো। তার ছেলে মেয়ে বউ বলল, তবে তো তার কথাগুলোও জ্বলে যাবে গো… কি করবে, বিক্রি করবে?
কাঠুরে বলল, এ কথা নতুন কিছু না। একটা পুড়লে আরো জন্মাবে। এ মহাজাল। সবাই কি বাঁচাতে পারে বলো নিজেকে? বরং এসো আমাদের কাজ করি। বাজারে গিয়ে বেচে আসি।
(ছবি - ইন্টারনেট)