ফস্ করে কেউ মরে গেলে লোকে অনেকরকম কথা বলে। কেউ বলে, গ্যাস হয়েছিল। কেউ বলে, নেশা করত। কেউ বলে, আসলে গুপ্তরোগ ছিল, মানে এইডস।
আসল কথাটা কেউ জানল না কেন খগেন মারা গেল। ডাক্তার বলল, মাথার শিরা ছিঁড়ে গিয়েছিল।
প্রথম কথা মাথায় শিরা থাকে না। ঘিলু থাকে। আর খগেনের মত মানুষের মাথায় গোবর থাকে। যারা শুধু ভ্যান চালায়, আর ভ্যান চালায়। ভাই-বোনেদের লাথিঝ্যাঁটা খেয়েও পড়ে থাকে। গোবর দিয়ে রক্ত যায় না।
খগেনের মড়া নাকের কাছে জ্যান্ত মাছি। মৃত মানুষের মুখে এক একটা ভাব থাকে। কারোর মুখ দেখলে মনে হয় হাসছে। কাউকে দেখলে মনে হয় খুব গম্ভীর হয়ে গেছে। কেউ এমন হাঁ করে থাকে যেন এখনো কিছু বলতে চাইছে, না জল চাইছে? না ভাত?
খগেনের আগে অনেকে লাইনে। আগে মরেছে তাই আগে এসেছে, তুমি আগে মরতে পারোনি কেন? মরো মরো। আগে মরো। আগে লাইন পাবে।
খগেনের বড়দা আকণ্ঠ গিলে এসেছে। সে শুধু খাটের চারদিক ঘুরছে আর তারস্বরে কাঁদছে, ভাই এই কি তোর যাওয়ার সময়… ভাইরে…
আশেপাশের খাটে ধাক্কা লাগছে। মড়া বলে কেউ চমকাচ্ছে না খাটে শুয়ে শুয়েও। কিন্তু তাদের আত্মীয় বন্ধুবান্ধব রেগে যাচ্ছে… বলছে, ও দাদা… কি হচ্ছে… দেখবেন তো…
খগেনের দাদার পা টলছে… মধুর স্বরে বলছে, তোরা থাম না বোকাচোদারা…. আমার ভাই মরেছে দেখছিস না….
এত মোলায়েমভাবে বলছে লোকে ঠিক এগিয়ে এসে গলাটাও চিপে ধরছে না। তাছাড়া যার পা টলছে, জিভ জড়াচ্ছে তার সাথে শ্মশানে কে লড়ে!
খগেনের বোন গল্প করছে। চেনা মানুষ বেরিয়েছে। বান্ধবীর বর মরেছে। মাল খেত। লিভার পাথর হয়ে মরেছে। বান্ধবীর দেওরের সঙ্গে গল্প করছে। খালি গা। ঘাড়ে গামছা। পুরুষাঙ্গ ঢেকে হাফপ্যান্ট। হাতের পেশী ফুলে ফুলে উঠছে হাত নাড়ালেই। ঘামের গন্ধ আসছে গঙ্গার হাওয়ায় মিশে। চিতা জ্বলছে খগেনের বোনের বুকে। শরীর কামড়াচ্ছে। স্বাদ চাইছে। খগেনের বোনের বর উদাসী। মেয়েছেলের মত স্বভাব। শালা হাত-পা নাড়াও মেয়েদের। ওকি পুরুষ? বিছানায় নিলে বুঝতে! আদর করতে জানে না... ভালোবাসতে জানে না… খালি কাঁদে... ঝগড়া করে... আর খামচায়... নপুংসক শালা একটা।
খগেনের বোনের চোখের ভাষা বোঝে বান্ধবীর দেওর। ফোন নাম্বার দিল। আয় আয় ছিঁড়ে খাই। খগেনের বোন বলল, ছিঁড়ে খা আমায়। আমি পশু। তুইও তাই। ভাদ্রমাসে কুকুরগুলোকে দেখে আমার হিংসা হয়। আয় আয় আমায় তোর কুকুর কর। কেঁদে উঠল খগেনের বোন। চীৎকার করে বলল, ভাইরে…
তখন খগেনের খাটের পাশে বসে একটা শালিক। এক শালিক। অপয়া। মালা খুঁটে খাবার খুঁজছে। দূরে একটা কুকুর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। মালায় কি খাবার আছে? ফেলে যাওয়া চায়ের ভাঁড়ে লেগে থাকা শেষ চায়ের আঁশটুকু চেখে খায় সে। শ্মশানে ফেলে যাওয়া চায়ের ভাঁড়ে বৈরাগ্য লেগে থাকে। কুকুরটা বলল, কি খুঁজিস? শালিক বলল, পোকা।
খগেনের ছোটোভাই মিউনিসিপালিটিতে পার্মানেন্ট পদ চাইছে। না দিলে অনশনে বসবে ঠিক করেছিল আজ থেকে। দাদার মড়া মুখটা দেখে ইচ্ছাটা উবে গেল। মিউনিসিপালিটির বড়বাবু ভালো মানুষ। বোকা মানুষ। একা মানুষ। সে বলল, একা একা অনশন করা যায় না রে। মনের বল হারায়। তাছাড়া অনেক মহৎ উদ্দেশ্য ছাড়া নিজের স্বার্থের জন্য অনশন করাকে ব্ল্যাকমেল বলে রে। গান্ধীজি তাই বলতেন।
খগেনের ছোটো ভাই হেসে বলেছিল, বাল বলে কাকু। সব বালের কথা। বালের নীতি। ওসব ভাষণ আমায় মারাবেন না। আগে আমার চাকরি তারপর সব দেখব। পার্টির সব কাজ করব। গু-মুত চাটব।
ভালো মানুষটা ঘামতে ঘামতে টোটোয় উঠেছিল।
খগেনের ছোটোভাই মড়া দাদার পাশে বসে দুটো সেল্ফি দিয়েছে ইনস্টাতে। অপেক্ষা করছে লাইক বাড়ার। অনেক স্বপ্ন তার। একটা অ্যাডিডাসের জুতো, বড়লোকের বাড়ি মেয়ে এমন বউ, অ্যাপল ফোন, বুলেট বাইক, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া দুটো বাচ্চা, ব্যাঙ্কে কিছু টাকা, দোতলা বাড়ি একটা। ব্যস। ভ্যান চালক মড়া দাদার দিকে তাকালো। বলল, হোয়াট এ ওয়েস্টেজ!
উঠে গেল। বিড়ি ধরাতে হবে। ফালতু সেন্টি হয়ে লাভ নেই। বেকার খেটে মরল দাদাটা। এখন বৌদি আর বাচ্চাটাকে কে গেলাবে?
মড়া খগেন আর কারোর কথা ভাবছিল না। শুধু বোকা বউটা আর বাচ্চাটার কথা ভাবছিল। যখন ঘি মাখাচ্ছিল, বলছিল, রাখ রাখ, বাচ্চাটাকে দিস আমার। যখন আগুন দিচ্ছিল, তখন বলছিল, আমায় বউটার উনুনে দিস রে, যেন দুটো ফুটিয়ে দেয় বাচ্চাটাকে।
কেউ শোনেনি। আগুন বলল, ভোলো সব। তোমায় নেভাবো। এসো পুড়ে নিভে যাও।
বোকা খগেন পুড়ে যেতে যেতে বলল, ওরা না পারলে এদিকে ডেকে নিও। আমি অপেক্ষা করব।