(ঘটনা আর নামগুলো তো প্রায় সবারই জানা এখন)
তিনটে বাচ্চা, তিনটেই মেয়ে। অনেক দুর্ভাগ্য থাকলে তবেই হয়। মঙ্গল আর বীণার দু'জনেরই তাই মনে হয়। পারুল জন্মানোর আগে তাদের মনে হয়েছিল, এবার ছেলেই হবে। প্রথমে মানসি, তারপর শিখা, শেষে পারুল। মানসি আটে পড়েছে, বাকি দু'জন চার আর দুই।
মঙ্গল দিল্লীতে এলো। গ্রামে কাজ বলতে সেরকম আর কই? সেই তো চাষবাসই ভরসা। কিন্তু যা দিনকাল শুধু চাষবাসের উপর নির্ভর করে চলে না। মঙ্গলের অত পুঁজি কোথায় যে ভালো সার, কীটনাশক কিনবে? আর সরকারি সাহায্য চাইতে যা কাঠখড় পোড়াতে হবে, তাতে আর ক্ষেতে খাটার শক্তি থাকবে না। কিন্তু এতগুলো মানুষের মুখে খাবার তো পৌঁছাতে হবে? মঙ্গলের এক বন্ধু দিল্লীতে শর্মাজীর সাথে আলাপ করিয়ে দিল। শর্মাজীর চারটে টোটো চলে। একটা টোটো চালক গতমাসে কাজ ছেড়ে চলে গেছে, তাই মঙ্গলের ভাগ্যে শিঁকে ছিঁড়ল। কথা হল বীণা বাড়ির কাজ করবে, মঙ্গল টোটো চালাবে আর তারা সিঁড়ির নীচের ঘরটাতে ভাড়া থেকে যাবে। একটাই ঘর। ওখানেই বীণা গুছিয়ে নিল নিজের সংসার। দিল্লী, একটু ভয় ভয়ও করে। শুনেছে রাতে মেয়েদের সাথে এখানে অনেক কিছু হয়, তার তো আবার তিনটে।
তবু যা হোক শুরুটা ভালোই হল। দীপাবলি দেখতে দেখতে এলো। রোজগার যা আশা করেছিল তার চাইতে ভালোই হল। বীণার সাথেও বাড়ির সবার ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। শর্মাজীও মানুষটা খারাপ না, শুধু পয়সাটা পাইপাই উসুল করে নেয়। এমনকি দীপাবলির সময়েও একটা টাকা বেশি দেয়নি হাতে। বীণার খারাপ লেগেছিল, তাদের জন্যে না হোক, মেয়েগুলোর জন্যে তো একটা করে অন্তত জামা কেনা যেত! মেয়েগুলো পুরোনো ছেঁড়া জামা পরেই ঘুরল। এত আলো তারা আগে দেখেনি। এত সাজও না। মেয়েদের এত রকম পোশাক হয় তার ধারণাই ছিল না। প্যান্ট পরা মেয়ে সে টিভিতে অনেক দেখেছে গ্রামে থাকতে, চাক্ষুস এখানে করল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, এত নির্লজ্জ মানুষ হয় কি করে? পয়সা থাকলে আসলে সবই হয়, বীণা নিজের মনকে বোঝালো।
দুর্ঘটনাটা ঘটল হোলির দিন। মঙ্গল এমনিতে নেশা করে না। কিন্তু করতে শুরু করলে তাল ঠিক রাখতে পারে না, বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছে বীণা। সে এইবার হোলির আগের দিন তাকে বারবার বলেছিল সে যেন নেশাটা না করে, নতুন জায়গা, কাউকে চেনে না, কিছু বিপদ হলে বীণা তিনটে মেয়ে নিয়ে কোথায় যাবে?
মঙ্গল শুনল না। মাঝখান থেকে হোলির পরেরদিন বেলায় ফিরল, চুল উসকোখুশকো, জামা ছেঁড়া, কাঁধের কাছে রক্তের দাগ, কপালে কালশিটে। বীণা বুঝল সে যা ভয় করেছে তাই হয়েছে, নেশার ঘোরে মারামারি করে বাড়ি ফিরেছে, গ্রামেও যেমন করত। নেশা করলে মঙ্গল অন্য মানুষ, বীণার গায়েও হাত তুলেছে বহুবার। কিন্তু এবারের ঘটনা অন্য - তার টোটো চুরি হয়ে গেছে। ঠেকে সারারাত কাটিয়ে ভোরে এসে দেখে তার টোটো নেই। যদিও মঙ্গল বহুবার শর্মাজীকে সবটা বলল, তার দোষ নেই, লক করেই ঢুকেছিল, এ নিশ্চয় বিলালের কাজ, সে অনেকদিন ধরেই শর্মাজীর শত্রু, সেই লক ভাঙিয়ে টোটো নিয়ে পালিয়েছে।
শর্মাজী শুনল না। মঙ্গলকে বলল সে শুধু তার বাচ্চাগুলোর তাকিয়েই তাকে পুলিশে দিল না, কারণ তার সন্দেহ মঙ্গলই টোটোটা বেচে মদ খেয়েছে। শর্মাজী যদিও জানে যে টোটো বেচে মদ খাওয়ার মত শরীরের ক্ষমতা বা মনের ক্ষমতা কোনোটাই নেই মঙ্গলের, তবু তার শত্রুর সাথে মোকাবিলা করার মত মনের জোর শর্মাজীর ছিল না। বিলালের পঁহুছ অনেক দূর অবধি।
মঙ্গলকে বাড়ি থেকে তাড়ালো। মঙ্গল একটা বস্তিতে এসে বীণা আর দুই মেয়েকে নিয়ে উঠল। বীণার সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে। সে অনেকবার বলল মঙ্গলকে গ্রামে ফেরার জন্য, মঙ্গল রাজি হল না। যে ক'টা টাকা আছে সে ক'টা টাকায় একবেলা খেয়ে কোনো রকমে পনেরোদিন চলতে পারে, তারপর?
দিল্লীর গরম বীণা শুনেছিল। তাদের গ্রামের মতই, কিন্তু এত ঘিঞ্জি যে একটু বাতাস আসতে পারে না। মঙ্গল একটা ঠিকে কাজ পেয়েছে, কোথায় একটা ফ্ল্যাট হচ্ছে সেখানে। আজকাল তার মনমেজাজ ভালো থাকে না। প্রায়ই রাতে মদ খেয়ে ফেরে, মেয়েগুলোকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে, তাকে মারধোর করে, বীণাই একটা জলজ্যান্ত অপয়া - তাকে বারবার বলে। বীণার কষ্ট হয় না, ভয় হয়। দিল্লীতে তার ভীষণ ভয়, তার নিজের মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকালে হাড় হিম হয়ে যায়, নির্ভয়ার কথা মনে পড়ে। তার নিজেকে নিয়েও ভয় হয়।
মঙ্গল কাজে যাওয়া ছেড়ে দিল একপ্রকার। যা টাকা ছিল ফুরাতে বেশিদিন লাগল না। বর্ষা ঢুকে গেছে দিল্লীতে। বীণা একটা কাজ খুঁজছে, কিন্তু এই তল্লাটে ঠিকে ঝি রাখার মত অবস্থা সেরকম কারোর নেই। যা সব আছে দূরে দূরে, কিন্তু মেয়েগুলোকে রেখে যাবে কার ভরসায়। আজকাল তো বাচ্চাদেরকেও ছাড়ে না পিশাচগুলো শুনেছে। মঙ্গলের নেশা ছুটে গেলে সে কয়েকবার কাজ খুঁজতে বেরিয়েছে। আসলে তার মাথায় যে চুরির দাগাটা দেগে দিয়েছে শর্মাজী সেটাই যে মঙ্গলকে ভিতরে ভিতরে শেষ করে দিচ্ছে সেটা বুঝেছে বীণা। কিন্তু তবু, অন্তত মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে তো...... কাকেই বা বলবে আর? আর কতই বা বলবে।
মঙ্গলবার, চব্বিশে জুলাই, ভোরে মঙ্গল বেরিয়ে গেল কাজ খুঁজতে। আসলে সে কাজ খুঁজতে যায়নি, সে পালালো। মেয়েগুলোর চোখের তলায় কালি, না খেতে খেতে হাড় বের করা শরীরে ঝুঁকে ঝুঁকে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে হাঁটার চেষ্টা, পিত্তি বমি করতে করতে ছোটোটার নেতিয়ে শুয়ে থাকা - আর সহ্য হচ্ছে না। তার চাইতে বড় কাঁটা ওদের স্থির, শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকা। বীণা শুয়েই থাকে, ওঠে না। কি করবে আর উঠে? সোমবার রাত থেকে পারুল আর শিখা চোখ খুলছে না। মানসি ডাকলে সাড়া দিচ্ছে, কিন্তু বাকি দু'জনের কোনো সাড় নেই। চামড়াগুলো ঝুলে মাটির সাথে মিশে গেছে ছেঁড়া চাটাইয়ের মত। ওদের মুখের কাছে বীণা খবরের কাগজ রেখে দিয়েছে, বমি পড়লে যেন মেঝেতে না পড়ে, পিঁপড়ে হয়ে মেয়েগুলোকেই কামড়াবে। শিখার মুখের কাছে খবরের কাগজে রাহুল গান্ধী প্রধান মন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আছে সেই ছবি। প্রধান মন্ত্রীর ছবির চোখের কাছে শিখার বমির দাগ।
বীণা জানে মঙ্গল পালালো। পুরুষ মানুষ, আর কতদিন সহ্য করবে। বীণা মনে মনে বলল, ও মরুক। মরে গিয়ে বাঁচুক। তারপর পাশের বাড়ি ছুটল, মানে হাঁটল টলতে টলতে, হাস্পাতালে যেতে হবে। মেয়েগুলো চোখ খুলছে না।
বাকিটা আমি খবরের কাগজ থেকেই বলছি, চিকিৎসকেরা হাস্পাতালে আনার পর ওদের মৃত বলে ঘোষণা করেন। ময়নাতদন্তে সারা পেট তন্নতন্ন করে খুঁজেও একটা ভাতের দানা পাওয়া যায়নি। এমনকি সরকারের নির্দেশে অনেক বড় বড় চিকিৎসক ওদের পেট চিরে আরো কাছ থেকে দেখে শুঁকেও এক কণা ভাতের চিহ্ন পাননি। দীর্ঘ অনশনের সব চিহ্ন নাকি ওদের শরীরে ছিল। আবার তদন্তের নির্দেশ এসেছে উপর থেকে। দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী কেজরিবালের দপ্তরে সাংবাদিকেরা গিয়ে বিনা চা বিস্কুট আর এমনকি বিনা নিউজ ফুটেজ ফিরে এসেছে। ওরা কথা বলবে না এই বিষয়ে। বীণার কেমন লাগছে কোনো সাংবাদিক প্রশ্ন করছেন, মঙ্গলের সাথে অন্য কোনো নারীর সম্পর্ক ছিল কি না দেখতে হবে, সে সত্যি টোটোটা চুরি করেছিল কিনা তাও তদন্ত হতে পারে। তবে বীণা এখন অনেক নিশ্চিন্ত। মানসি, শিখা বা পারুলের বমি তাকে আর পরিস্কার করতে হবে না। পিত্তি বমির বড্ড টকটক গন্ধ। আর একটা বড় কথা নির্ভয়া হওয়ার ভয়ও তাকে পেতে হবে না। অত সাংবাদিক একা সামলানো বড্ড ঝক্কি যে!