সৌরভ ভট্টাচার্য
11 December 2016
লোকটার ছিল ভীষণ পিপাসা। সারাদিন তাই আগল দিয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখতে চাইত সবার থেকে। তার দরজায় ছিল ছোট্ট একটা ছিদ্র। একটা বড় পিঁপড়েকেও ঢুকতে হত সে ছিদ্র দিয়ে কষ্ট করে। সেই ছিদ্র দিয়ে সে দূরে তাকিয়ে থাকত দিনের বেলায় অনেকক্ষণ। দূরে দেখত, সূর্যের আলোতে মুক্তার মত আলো ঝলসানো চোখ ধাঁধানো নদী। কত মানুষ যাচ্ছে ফিরছে সেই নদীর দিকে। যারা ফিরছে তাদের সর্বাঙ্গ ভিজে। কারোর কাঁখের কলসীর থেকে ছলকে ছলকে পড়ছে জল। তার তৃষ্ণার জল। সে আরো পিপাসার্ত হয়ে উঠত। তবু আগল খুলে আসত না বাইরে। পাছে লোকে জেনে যায় তার বুকে আছে অতল পিপাসার অন্ধকার। ছিঃ ছিঃ, লজ্জা পাবে না সে!
একদিন ভাবল গভীর রাতে সে যাবে। বেরোলো চাদরে শরীরের সর্বাঙ্গ ঢেকে। এমনকি একটা খুব উঁচু জুতো পরে নিল যাতে তার উচ্চতা পরিমাপেও কেউ না করে সন্দেহ তাকে। অথচ সে ছিল খুব সাধারণ মাপেরই উচ্চতাযুক্ত মানুষ। যা হোক, ধীর পায়ে সে এগোতে লাগল নদীর দিকে। যেই না মাঝপথ অবধি এসেছে, হঠাৎ করে খুব জোরে দিল হাওয়া। আম, জাম, বট ইত্যাদি সব গাছগুলো যেন ঝুঁকে পড়তে লাগল মাটির বুকের কাছে। লোকটার মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল মুহুর্তেই। সে ভাবল, এই উত্তাল হাওয়ায় নিশ্চই তার গায়ের গন্ধ পৌঁছাবে গ্রামের সব মানুষের নাকে, আর এই গাছগুলো যে ঝুঁকে তার মুখটা দেখে নিল ( খুব হাওয়ায় মুহুর্তের জন্য তার চাদরের আড়াল গিয়েছিল সরে) তারা যে সব সাক্ষী দেবে কাল সকাল হলেই সব্বাইকে। বলবে, জানো ওই পুব দিকের বাড়ির আগল দেওয়া লোকটার সে কি পিপাসা!
অথচ তার গায়ের গন্ধও ছিল আর সবাকার মত এক, আর তাকে চিনত না কোনো গাছই, ফলে সাক্ষী দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
লোকটার দিন সেভাবেই কাটতে লাগল। সারাটা দিন নদী দেখে সেই ছিদ্র দিয়ে আর সারাটা রাত সে নদীর গর্জন শুনে। আর যেটুকু সময় সে ঘুমাতো, দেখত নদীর স্বপ্ন। সে যেন ভীষণ আদর করছে নদীকে, নদীও তাকে দিচ্ছে জীবনের পরম সুখ বলতে যা কিছু বোঝায় সব।
অবশেষে লোকটা একদিন মারা গেল। গ্রামের লোক টের পেলো দুদিন পরে যখন তার শরীরে ধরেছে পচন। সে বিশ্রী গন্ধও আর সব লোকের মৃত শরীরের বিশ্রী গন্ধের মত একই।
লোকটার ভগবানের কাছে আনা হল। তখন ভগবান ক্ষেতে বীজ ছড়িয়ে সবে একটা পারিজাত গাছের তলায় বসেছেন। লোকটাকে আনা হল তাঁর সামনে। একজন স্বর্গদূত লোকটার সারাটা জীবনের কীর্তিকলাপ পাঠ করে শোনাতে লাগল। অবশ্য তা মাত্র কয়েকটা বাক্যেই হল সম্পূর্ণ। ভগবান সব শুনে বললেন, তুমি কি পিপাসাটা মিটিয়ে আবার আসতে চাও? লোকটা ঘাবড়ে গেল। বলল, না না, আমার পিপাসা তো নেই! ( লোকটা ভগবানকেও মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা করল, যেমন আর সাধারণেরা করে, আর নিজেদের খুব চালাক ভাবে, তারপর একদিন হঠাৎ করে তাদের বুকের ভিতর থেকে কি একটা খসে পড়ে যায় তারা খসার মত, লোকেরা বুঝতেও পারে না সে খাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। দেয় ঝাঁপ।)
ভগবান তখন ওকে বললেন, ঠিক আছে, আগামী তিন সহস্র বছর তুমি ওই নদীটার ধারে একটা পাহাড় হয়ে কাটাবে। তোমার প্রতিটা পাথর থাকবে ততদিন শুকনো, যতদিন না তুমি তোমার মাথার উপর থেকে একটা ঝর্ণা বানিয়ে ওই নদীর সাথে মেশাতে না পারছ।
সেই পাহাড়ের চূড়ার উপর বসা এক যুবক গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী আনমনা হয়ে কি যেন একটা ভাবছিল। তার দৃষ্টির তীর ধরে গেলে দেখা যাচ্ছে ওই নদীর তীরে এসেছে পল্লবী, ধোপার অবিবাহিতা যুবতী কন্যা, বাবাকে সাহায্য করতে।
পাহাড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে দীর্ঘশ্বাসের হাওয়ায় সন্ন্যাসীর গায়ের থেকে গেরুয়া চাদর গেল উড়ে। পাহাড় দেখল তার নগ্ন গা আর সব পুরুষের মতই নগ্ন। পাহাড় বুঝল যেন কিছু। মনে হল তার চূড়ার কাছটা একটু যেন ভিজে ভিজে।