ভীষণ অস্থিরতার মধ্যে রাগটা শেষ করতে হল। রাগ ‘জয়জয়ন্তী’। রাগটা ফুটল না। কোমল গান্ধারে সুরটা ঠিক লাগল না। কোমল গান্ধারে হৃদয়টা যেন পাহাড়ের চূড়ায় এসে দাঁড়ায়। সেখান থেকে সব অনুভূতি গলে গলে নদী হয়। আজ হাতড়ে হাতড়ে সে চূড়া অবধি ওঠাই গেল না। কে যেন নীচের দিকে পা টেনে থাকল।
অভিষেক বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালো। ঘড়ি দেখল, পৌনে তিনটে। বারাকপুরের সুকান্তসদনে গাওয়াটা তার কাছে একটা বিশেষ দিন। তার মায়ের হাত ধরে নৈহাটি থেকে আসত গান শুনতে। মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল সে সুকান্তসদনে সে গাইবে। প্রথম গেয়েছিল কলেজে পড়তে, সেকেণ্ড ইয়ারে। মা শুনেছিলেন। ইমন গেয়েছিল।
হলে ঢুকতে ইচ্ছা করছে না। মধুরিমা বাগেশ্রী গাইছে। থাক। ফেরার ট্রেন দেরি আছে। অভিষেক স্টেশানের উল্টোদিকে চিড়িয়ামোড়ের দিকে হাঁটতে শুরু করল। এখনও মাথার মধ্যে জয়জয়ন্তীর ছেঁড়া ছেঁড়া সুর ভেসে আসছে। অন্যমনস্ক হয়ে গুনগুন করছে। এই রাগটা প্রথম ভালো লাগে শ্রদ্ধেয়া দীপালি নাগের গলায়। রেডিওতে শোনা। আহা, কি কণ্ঠস্বর, কি বলিষ্ঠ গায়কী। নিজের উপর রাগে অভিমানে চোখে জল আসছে অভিষেকের।
চিড়িয়ামোড়ে এসে দাঁড়ালো। ফিরে যাবে? না, গঙ্গার দিকে যেতে ইচ্ছা করছে। যদিও শীতটা আজ খুব বেশি। কিন্তু মনটা এমন বিগড়ে আছে কিচ্ছু মালুম হচ্ছে না শরীরে, অসাড় লাগছে সব। সিগারেটটা শেষ। “খানা, গানা ওর পাগড়ী – কভি কভি বনতি হ্যায়”, শুনেছে। নিজে বলেও তো ছে কত কাউকে। কিন্তু নিজেকে বলতে পারছে না আজ। গালের উপর চোখের জল গড়িয়ে শুকিয়েছে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। আচ্ছা, যদি মালকোষ গাইত? মালকোষের কোমল গান্ধার জয়জয়ন্তীর মত করুণ তো নয়। আজ কি সে নিষ্ঠুর ছিল? মালকোষের কোমল গান্ধার যেন দিব্য, জয়জয়ন্তীর কোমল গান্ধার যেন চোখের জলের দমক।
আসলে সাত্যকির গানটাই তার মাথা খারাপ করে দিল। তার আগেই আভোগী-কানাড়া গাইল। ভীষণ কষ্ট হয়েছে ওর গানটা শুনতে শুনতে, একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়েছে মনে মনে। কি করে ওভাবে গাইতে পারে ও? কানাড়ার, কোমল গান্ধারের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়াটা সহ্য করতে পারে না অভিষেক। বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। সমস্ত পাঁজরগুলোকে ভেঙে বুকটা চৌচির করে দিয়ে গেল সাত্যকি আজ, কোমল গান্ধারে। তার কোমল গান্ধারকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল ও। বর্ষা হলে মল্লারের মন্ত্রে সে ফিরিয়ে নিয়ে আসত কোমল গান্ধারকে, কিন্তু জয়জয়ন্তী ভীষণ নম্র, তার সে জেদ নেই। হয় সে আসে, নয় আসে না। তার উপর জোর খাটে কই? সকালের দেশি আর রাতের জয়জয়ন্তীকে অশুদ্ধ হৃদয়ে ছোঁয়া যায় না। আজ মন অশুদ্ধ ছিল, ঈর্ষায়।
কখন গঙ্গার সামনে এসে পড়লাম? অভিষেকের মনের মধ্যে বিস্ময় জন্মালো। ভক্তির বিস্ময়। যেন গঙ্গা নিজে তার সামনে এসে দাঁড়ালো, যখনই নিজের মধ্যের পাপটাকে চিনতে পারল সে। অন্ধকারটা কেটে যাচ্ছে। বাইরের আর ভিতরের একসাথে। এই রাস্তাটা ধরে দু’পা এগোলেই শ্রী অরবিন্দের মন্দির। আর একটু এগোলেই মহাত্মা গান্ধী ভবন।
হঠাৎ কার যেন গলার আওয়াজ, কে গাইছে? একজন অবাঙালী। এ সুর চেনা। রামচরিতমানস। কি পদ গাইছে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু সুরটা চেনা। পূর্ব দিকের আকাশ অল্প অল্প করে পরিষ্কার হচ্ছে। রামচরিতমানসের সুরের সঙ্গে ঝাঁটার আওয়াজ। সে রাস্তা ঝাঁট দিতে দিতে গাইছে। তার দিকে তাকাতেই, “রাম রাম বাবু” বলল হাত আর গান থামিয়ে, একগাল হেসে। আবার সে গাইছে, আবার রাস্তায় ঝস ঝস আওয়াজ।
এত অহংকার কিসের আমার? এত শক্ত ‘আমি’ জন্মে যায় কি করে হৃদয় ফুঁড়ে? ওর পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে ইচ্ছা করছে। এত সাধারণ, এমন তৃপ্ত জীবনের হাসি। এমন দাবি-অভিযোগহীন ভক্তি কেন জন্মায় না মনে? যাক সে কোমল গান্ধারের অভিমান। এই তো সুর! সে কি একা গান্ধারে? সে তো কড়ি-কোমল সব ছাড়িয়ে প্রাণের বীণায় বাজছে। প্রাণের সুরের শিক্ষা হয়নি যে, কণ্ঠের সুর বাজবে কি করে গলায়?
অভিষেক তার সামনে দাঁড়ালো। হাত জোড় করে বলল, রাম রাম জী।
সেও, ঝাঁটা থামিয়ে, গান থামিয়ে বলল, রাম রাম জী...
চায়ের দোকান কোথায় আছে বলতে পারবেন?
সে সোজা আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই যে, দুকান খুলছে... ভালো চা বানায় বাবুজি... দিল খুশ হয়ে যাবে... যান... পিয়ে লিন...
তার হাতে আবার ঝাঁটা আর গলায় রামের সুর। অভিষেক ফিরছে।
পিয়ে তো নেবই... তোমার সামনে হাতজোড় করে দাঁড়াতেই আমার সব সুধা পান হয়ে গেল... তুমি কে জানি না... কিন্তু তুমিই আমার গুরু হয়ে রইলে... আমার প্রাণের সুরের গুরু...
অভিষেক গাইছে আহির ভৈরবে, "পিব রে, পিব রে রাম রসম / রসনে, রসনে... পিব রে... পিব রে..."