Skip to main content

        মাটির তলায় ঘর বেঁধে কিছু মানুষের সারা জীবন কেটে যায়। বাইরের আলো-বাতাস কিছুই সে ঘরে ঢোকে না। ওনার নাম কি? ধরে নিই লতা। দেখতে ভাল নয়। তাই কুলতা? না সুলতাই থাকুক। ভদ্রতা মানেই তো মিথ্যা কথা গুছিয়ে বলা। মন আর মুখ এক হলে সমাজে টেকা দায়। আমি যখন দেখেছি তখন বয়েস পঞ্চাশ হবে। তবে আমি ভুলও হতে পারি। জীবনের খরচ অনেক বেশী যাদের তাদের বয়েসের সাথে শরীরের বোঝাপড়া বোঝা বড় দায়। তিরিশেও চল্লিশের ছোঁয়া লেগে যায়। সুলতার তাই কি না বলতে পারি না। তবে ফাঁকা চালের টিনের মত চাহনিটা যেন সেই রকমের কিছু একটা ইঙ্গিত করে। আমি আমার এক আত্মীয়ের বাড়ি যখন যেতাম তখনই ওনাকে দেখতাম। সৌজন্যমূলক কয়েকটা অর্থহীন বাক্য বিনিময় ছাড়া আর কিছুই হয়নি। তবু চোখকে তো ফাঁকি দেওয়া যায় না, তাই কোথাও মনে হত উনি বুঝতেন আমি ওনাকে বোঝার চেষ্টা করি। তবু “কেমন আছো, কবে এলে, বাবা মা কেমন আছেন, পড়াশোনা ঠিক চলছে কিনা” এর বেশি কিছু কথা কোনোদিন এগিয়েছে বলে মনে পড়ে না। ওনার সম্বন্ধে জানা এক, আমার আত্মীয়ের কাছ থেকে; দুই, মানুষের যে জন্মলব্ধ আরেকজন মানুষকে জানার অধিকার, তার মাধ্যমে। দ্বিতীয় ক্ষমতাটা আছে বলেই সভ্যতার হাত থেকে কোথাও একটা রেহাই পাই, নইলে সাজানো কৃত্রিম ফুলের বাগানে মৌমাছির গুঞ্জন শোনা দায় হত।
        যৌথ পরিবার ওদের। তিন ভাইয়ের সংসার। ওনার স্বামী বড়। তিনি কলকাতায় ট্রাম চালাতেন। বাকি দুটো ভাই টুকটাক কিছু করত। না চলারই মত প্রায়। দাদাই প্রধান উপার্জনক্ষম। আমি ওনাকে প্রথম দেখি একদিন ভোরবেলা। আমার বরাবর ভোরে ওঠার অভ্যাস, দোতলার বারান্দায় কিছু একটা বই পড়ছি, হঠাৎ গেটের আওয়াজ হল। বসে বসেই মুখ বাড়িয়ে দেখলাম উনি চারপাশটা একবার ভালো করে দেখে নিয়ে ফুল পাড়তে শুরু করলেন। আমার ওই কাকিমার খুব ফুলের শখ। পূজোর ফুল অবশ্য। শৌখিন ফুল বলতে শীতে ডালিয়া আর চন্দ্রমল্লিকা। গরমে জবা, টগর ইত্যাদি। উনি তাই পাড়ছেন। আমায় খেয়াল করেননি। আমার ব্যাপারটা খুব কেমন একটা লাগতে লাগল – চুরি করছেন? অমন ধরা পড়ার ভয় নিয়ে নিয়ে কি পূজোর ফুল তুলছেন, আর চুরির ফুলে ঠাকুর তুষ্ট হয় বুঝি? ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে একতলায় নেমে এসে গেট খুলে বাইরে এলাম, উনি বেরিয়ে গেছেন ততক্ষণে, ওনার ঘরের দরজা দিয়ে ভিতরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন দেখলাম।
        পরেরদিন তক্কে তক্কেই থাকলাম। যথারীতি পৌনে পাঁচটা নাগাদ গেটে আওয়াজ। জবার ডালটা নীচু করে একটা ফুলে হাত দিতেই আমি বাইরে এসে দাঁড়ালাম। উনি থতমত খেলেন, মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়ে একটা আড়ষ্ঠ হাসির রেখা ফুটে উঠল, আমি বিজয়ের গর্ব অনুভব করলাম।
        এরপর উনি রাস্তায় দেখা হলেই হেসে কথা বলতেন। আমার কথা বলার মধ্যে একটা তাচ্ছিল্যই হয়ত বা থাকত। সেটা বদলালো একটা চূড়ান্ত বর্ষার দিনে। আমি ফিরতে পারিনি বাড়ি। দু'দিনের জায়গায় চারদিন হল। শুনলাম ওনার ভীষণ জ্বর, আমার কাকিমার সাথে দেখতে গেলাম। চোখমুখ কাহিল। একটা ছেঁড়া ছেঁড়া কাঁথা গায় দিয়ে শুয়ে আছেন। আমরা যেতেই উঠে বসার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। দুটো চেয়ারে আমি আর কাকিমা পাশাপাশি বসলাম। একটা তিনজন শুতে পারার মত খাট। দেওয়ালে মা কালী, লোকনাথ বাবা, ক্যালেণ্ডার, পাঁচটা দশ বেজে থেমে থাকা ঘড়ি, দেওয়ালে এখানে ওখানে উইপোকা, ড্রেসিং টেবিলের কাঁচে দুটো লালটিপ আটকানো, একটা জানলা রাস্তার দিকে, আরেকটা আমার মাথার পিছনের দিকে, উঠোন আছে মনে হয়, অনেকের কথা কানে আসছে, রান্নার ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে। কাকিমা আর উনি কথা বলছেন, আমি একটা পঞ্জিকা টেনে পড়বার ভান করতে থাকলাম, কানের মোহনায় কথার স্রোত ঢুকছে। 
- ডাক্তার দেখাওনি?
- না দিদি
- কেন?
- আর এই ক'দিনের জ্বর, ভাইরাল, প্যারাসিটামল খাচ্ছি
- কিন্তু তোমার তো আর না হোক সাতদিন হল, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া টেস্ট করেছ?
(উত্তর নেই। আড়চোখে দেখলাম, একটা অস্বস্তিকর হাসিতে কোনো বড় অস্বস্তিকে ঢাকতে চাইছেন)
- আরে, আমি পুপুনের (কাকিমার ছেলে) বাবাকে বলব তারককে পাঠিয়ে দিতে রক্তটা নিয়ে যাক কাল?
- না না (আঁতকে ওঠা সুর, আমি বই থেকে চোখ তুলে সরাসরি ওনার দিকে তাকালাম) উনি আমার দিকে তাকিয়েই কাকিমার দিকে তাকিয়ে বললেন, খুব রাগারাগি করবেন... জানোই তো সব...
- মানে কি? তোমার সুগার, প্রেসার, থাইরয়েড এগুলোর সাথে যুঝতে যুঝতে তো শরীরে কিছুই নেই, তাও তুমি অ্যালোপাথি দেখাবে না! দাদা তো বেশ ডাক্তার মিত্রের চেম্বারে ঘটা করে প্রতিমাসে চেক-আপে যান, তা তোমার বেলায় হোমিওপ্যাথি কেন? (কাকিমার সুর চড়ছে, এটা কাকিমার স্বভাব, ন্যায্য কথা গলা চড়িয়ে বলা, তাই সুগৃহিনী হয়ে ওঠা কোনোদিন হয়নি ওনার)
- তুমি তো জানো আমার অ্যালোপ্যাথি সহ্য হয় না...
- তুমি ওসব অন্য কাউকে বুঝিও...

        বৃষ্টি নামল মুষলধারে। টিনের চালে তুমুল শব্দ। এ শব্দের অভিজ্ঞতা কম আমার, তাই সামনের দুই রমণীর থেকে মন সরিয়ে খানিক বৃষ্টির এই নতুন ধরণের আওয়াজে মনোনিবেশ করলাম। সামনের পাতায় দশই ফাল্গুন খোলা। আমার মাথার ওপরে শ্রাবণের ধারাপাত। নির্বিকার ভগবানদের দিকে তাকালাম। থেমে যাওয়া দেওয়াল ঘড়িটায় একটা টোকা দিতে ইচ্ছা করল। থেমে থাকা ঘড়ি দেখতে বড় বাজে লাগে আমার। মৃতদেহ মনে হয়। বাইরের আওয়াজগুলো নেই। কয়েকটা বাচ্চা দৌড়াদৌড়ি করছে ভিতরে টের পেলাম। আমি কান্নার আওয়াজ পাচ্ছি। কাকিমা কাঁদছেন। বুঝতে পারছিলাম এটা হবে। মেঘ জমছিল। আমার কাকিমার এটাও আরেকটা দিক, অসহায়তাকে কান্না দিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া। যেন কোন দয়াময় ঈশ্বরের দরবারে সে কান্নার আর্তি গিয়ে পৌঁছাবে। মানুষ দয়া বোঝে, তাই ঈশ্বরের দয়া খোঁজে; কয়েকটা ধ্বংসপ্রাপ্ত সভ্যতা, দুটো বিশ্বযুদ্ধ, এত অনাচার সব কাটিয়েও খোঁজে, কারণ এত কিছুর পরেও যেহেতু তার নিজের ভিতরের দয়াটা মরেনি, তাই তার স্থির বিশ্বাস ঈশ্বর নিশ্চই বিশ্বাসঘাতক হবে না। তবু হয়। মানুষ বিশ্বাসঘাতক ঈশ্বরের নাম দেয় – বিধাতা। ললিতে–কঠোরে মিশ্রিত বিধাতা।
        উনি জানলার বাইরে তাকিয়ে। যেন জীবনের সাধারণ চাহিদাগুলো জানলার বাইরে রেখে এসেছেন, হারিয়ে এসেছেন। ড্রেসিং টেবিলে ওনাদের বিয়ের ছবি ল্যামিনেশান করে রাখা। রুগ্ন, করুণ দুটো চোখ। বাপের বাড়ি ছিল ভীষণ গরীব। ওনার ঠাকুমা আর ওনার স্বামীর ঠাকুমা দুই সই ছিলেন, তাই এই বিয়ে। নইলে সরকারি চাকুরের অমন কুশ্রী বউ হয়? এটা ওনার স্বামীর জীবনে একটা চূড়ান্ত অপূর্ণতা। কিন্তু ওই বিধাতার দায় এমনই যে সে অপূর্ণতার দায়ভার মাথায় নিয়ে এ ঘরে ঢুকলেন, কিন্তু তার থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো পুঁজি বিধাতার দিতে স্মরণে ছিল না। আসলে বিধাতা তো শিশুস্বভাব – সাধকের কথা। তাই কয়েকটা ছেঁড়া হিজিবিজি টানা খাতার পাতার মত অর্থহীন জীবন এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থাকলে কি করে বোঝা যাবে সংসারে একটা শিশু বিধাতা আছে?


        পনেরো দিনের জ্বরে উনি মারা গেলেন। আমি ফোনে খবরটা পেয়েছিলাম। কয়েকটা দিন যে কি নিদারুণ বিবেকের যন্ত্রণায় ভুগেছিলাম, বারবার মনে হত অত ভোরে না উঠলেই হত। আর উঠলামই যদি না হয় না-ই তাকাতাম বাগানে। ওইটুকু সাধও তার অপূর্ণ রয়ে গেল আমারই জন্য, আমার মূঢ় নীতির জন্য। আসলে অনুকম্পা ছাড়া সংসারে কোনো নীতিই অহং মুক্ত নয়, এটা বুঝতে অনেক পুড়ে, অনেক প্রাণের চেয়ে প্রিয় সম্পদ কালের স্রোতে হারিয়ে হারিয়ে চরম মূল্য চুকিয়ে বুঝতে হল।
        পরে একবারই ওনার ঘরে গিয়েছিলাম। ওদের বাড়ির কোনো ছেলেকে কিছু একটা পড়ার বিষয় বোঝাতে। ওনার ঘরের দেওয়ালে ওনার একটা ছবি – রঙীন ছবি। হাসি মুখের ছবি। খাটের কোণে রাখা সেই কাঁথাটা – ছেঁড়া ছেঁড়া। ফাল্গুন মাস ছিল সেটা। পিছনের উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিলাম গিয়ে, একটা কোকিল আমায় ব্যঙ্গ করে ডেকেই যাচ্ছিল, – কি দেখছিস... কি দেখছিস... একটা গাছ লাগানোরও জায়গা নেই সত্যি। ওনার ঠাকুরের সিংহাসন দেখলাম, একটা জবা মা কালীর পায়ে। কোন বাড়ির জবা?