Skip to main content

সমস্যা হল মোমবাতিটা কোথায় রাখবে। কারেন্ট চলে গেছে। বাথরুমটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই সময়টা রোজ গা ধোয়া অভ্যাস। নইলে কে ঢোকে এই সময় এই অন্ধকারে।

    পঞ্চাশ বছরের শরীরের ভারটাও কম না। বাইরে গুমোট। যদিও বৃষ্টি হচ্ছে। মোমবাতিটা একটা কাপের মধ্যে রেখে শাড়িকাপড় খুলে কমোডে বসল। আলোটা কাঁপছে। থরথর করে ছায়া দেওয়ালে নড়ছে। খুব জোরে একটা বাজ পড়ল। কোনো কোনো বাড়ি থেকে শাঁখ বাজাচ্ছে। সন্ধ্যা হয়ে গেল? তা হল তো। ছটা তো বাজেই প্রায়। পেটটা অল্প মোচড় দিল। আম। গতকাল রাতে চারটে আম খাওয়া গেছে। যাক গে। ও আর কয়েকবার হবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।

    এইবার গা ধুতে হবে। গায়ের হুড়হুড় করে জল ঢেলে বেরিয়ে যাবে ভেবেও বেরোতে ইচ্ছা করল না। এখন কোনো সিরিয়াল নেই। বেরোলেই এটাসেটা করতে ইচ্ছা করবে। তার চাইতে বসতে ইচ্ছা করল বেশি। একটা সাদা পিঁড়ির উপর বসল। পা দুটো সামনে টানটান ছড়িয়ে। বৃষ্টির আওয়াজ শুনতে লাগল। ছোটোবেলার কথা ভাবতে ভালো লাগে। কিন্তু এখন ভালো লাগছে না। গুনগুন করে একটা গান গাইছে, কি গান বুঝছে না। মনে হল সুচিত্রা সেনের সিনেমার গান এটা। কি যেন নামটা সিনেমার। এই অস্বস্তি হতে শুরু করল। নামটা মনে না পড়লে তো মনটা যাচ্ছেতাই রকমের খচখচ করবে। কিন্তু ওকে যেই জিজ্ঞাসা করবে অমনি ধুম করে বলে দেবে। মানুষের মাথাটায় কি হয়? মেয়েদের মাথাটা কি অন্যরকম? রঙ মনে থাকে, সুর মনে থাকে, মুখ মনে থাকে। নাম মনে থাকে না। ফোন নাম্বার মনে থাকে না। বিরক্তকর। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল,

- তোমার কি দেরি হবে?

- কেন?

- আমার একবার যেতে হবে মনে হচ্ছে।

- কেন নীচেরটায়?

- না না, ওটায় আমার বসতে অসুবিধা হয়...

- আচ্ছা বলছি, এই... আরো কিছুক্ষণ না হয় রহিতে কাছে....এটা কোন সিনেমার যেন...

- পথে হল দেরি

- ঠিক... আরে আমার কিছুতেই মনে আসছিল না...

- বলছিলাম, দরজাটা খোলো.. মনে তো হচ্ছে মেঝেতে বসে আছো.. আমি না হয় কমোডে বসি আর তুমি না হয় মেঝেতে বসে গাও..

- দাঁড়াও দাঁড়াও এখুনি বেরোচ্চি... যত্তসব ভুলভাল কথা....

    মোমবাতিটা বাথরুমেই রেখে বাইরে এসে সোফায় বসে বলল, সিগারেট শেষ হলেই বেরিয়ো। ঘরে ধরিও না। বলতে বলতেই কারেন্ট চলে এলো। তাড়াতাড়ি টিভিটা অন করে বসতে যাবে, হঠাৎ বাথরুমের ভিতর থেকে ডাক। পৃথা তাড়াতাড়ি দরজার কাছে গিয়ে ধাক্কা দিল, কি হয়েছে?

- বলছি, এখন গায়ে জল ঢাললে কি ঠাণ্ডা লাগবে?

- মাথায় দিও না। পেট ঠিক আছে? পেটে সরষের তেল দিয়ে থাবড়িয়েছ কয়েকবার?

- হুম, পেট ঠিক আছে।

- চা খাবে, বসাবো? আদা দেব?

- না আদা দিও না।

- মানে পেটে সমস্যা..

- অল্প।

- আজ আম বাদ।

- তোমারও।

- আমার কিছু হয়নি।

- যুধিষ্ঠির।

- মানে?

- ফ্লাশ করোনি।

- ছি ছি... আচ্ছা আমি চা বসালাম...

    সিরিয়াল চলছে। কিন্তু মিউট করা। অলোকেশ মোবাইলে মগ্ন। পৃথার মোবাইলে 'পথে হল দেরি' চলছে। অলোকেশ একবার জিজ্ঞাসা করল, টিভিটা অফ করে দিলে হত না?

- না, এখানে কি হবে আমি জানি, ওখানে কি হবে জানি? জানো তুমি?

- না তা অবশ্য জানি না।

    সিনেমা শেষ হল।

- আজ আর রুটি করছি না। ভাত আর ডাল, সঙ্গে আলু ভেজে নিচ্ছি।

- একটা আম কাটলে হত না?

    দু’জনেই চুপ।

    রাতে খাবার পাতে দুজনের থালার পাশে দুটো করে আম।

    অলোকেশ আঁটি চুষতে চুষতে বলল, ট্যাঙ্কে জল তোলা আছে তো?

    পৃথা বলল, না, অন করে দাও পাম্পের সুইচটা। বলতে বলতেই ধুম করে কারেণ্ট গেল আবার।

    মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় ঘরের দেওয়ালে দুজনের কাঁপা কাঁপা ছাওয়া।

    পৃথা বলল, এইবার? ঝড় উঠল যে! রাতে কিছু হলে?

    অলোকেশ বলল, এত কিছু এতবড় জীবনে সামলে দিলাম একসাথে আর এটা সামলানো যাবে না? খবরের কাগজগুলো আছে তো? তোমার মনে নেই, শ্যামলের বিয়ের গল্প? তখন আমাদের বিয়ে হয়নি। বরযাত্রী গেছি। ছাদে শুতে দিয়ে ছাদের দরজা ভিতর থেকে দিয়েছে বন্ধ করে। এদিকে আমার মাঝরাতে তো অবস্থা খারাপ। পাঁঠাটা বেরোবে বুঝতে পারছি। কি করি। হঠাৎ মনে হল আমার ব্যাগে তো দু’দিনের কাগজ জমে, ব্যস...

    পৃথা হাসতে হাসতে বলল, শুনেছি, তোমার মা রসিয়ে রসিয়ে বলতেন....

    অলোকেশ আঁটিটা পাতে রেখে বলল, আজ মনে হচ্ছে আসবে না কারেন্ট... চলো কিছু চালানো যাক একটা। কি দেখবে?

    পৃথা বলল, নেটফ্লিক্স এ? আমার ভালো লাগে না... বাংলা কিছু দেখবে?

    দু’জনে বিছানায় পাশাপাশি বালিশ নিয়ে বসল। 'বিপাশা' চালানো হল। পৃথা একটু পরেই বুঝল অলোকেশ নাক ডাকছে। অল্প অল্প। ঘুমাক। নইলে একটু পরেই আবার ওই নেটফ্লিক্স চালিয়ে কি সব ছাইভস্ম দেখবে। কি যে দেখে?

    বাইরে ঝড় হচ্ছে। পৃথা মোবাইলটার সাউণ্ড কমিয়ে আলোটা অলোকেশের মুখের উপর ধরল। এই ঘুমন্ত মুখটাও এখন কত পরিচিত। একটা শেকল। বাঁচতে গেলে একটা শেকল লাগে। নইলে জীবন ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মায়া জড়ানো মন খারাপ জন্মালো। এটা বারবার হয়। অজানা ভয় হয়, ও না থাকলে? ভাববে না। মোবাইলটা অফ করল। অলোকেশকে জড়িয়ে মুখের কাছে মুখটা রেখে শুলো। যেন অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মুখটা। বাইরে ঝড় হচ্ছে। হোক। ভয় নেই। মনে মনে ঠাকুরকে ডাকল, পেটটা যেন না কামড়ায়। ফ্রিজের চারটে আম তবে কাবেরীকে দিয়ে দেবে রান্না করতে এলে। নিজের মানত করার বহর দেখে নিজেই হাসল। কিন্তু ঠাকুর পেটটা যেন না কামড়ায়।